মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১
The Daily Ittefaq

সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম যেন কাহারো ভোট সুরক্ষা কার্যক্রম না হয়

আপডেট : ০৩ জুন ২০২৪, ০৭:৩০

বাংলায় প্রবাদ রহিয়াছে—খলের ছলের অভাব হয় না। খল—অর্থাত্ যাহারা মতলববাজ, দুরভিসন্ধিতে সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকেন, তাহারা ছল করিয়া নিজেদের কার্যসিদ্ধি হাসিল করেন। উদাহরণস্বরূপ আমরা সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের কথা বলিতে পারি। আপাতভাবে মনে হইতে পারে, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সহিত ভোটের আবার কী সম্পর্ক থাকিতে পারে? কিন্তু নির্বাচনের মাঠের চিত্র যাহারা জানেন, তাহারা এই কথার মর্মার্থ বুঝিবেন। নির্বাচনে একটি কথা আমরা প্রায়শই শুনি—‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। অর্থাত্ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল প্রার্থী যেন সমান সুযোগ-সুবিধা পান এবং কেহ যেন অন্য কোনো উপায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তুলনায় অতিরিক্ত সুবিধা না পান। একটি ফুটবল ম্যাচে আমরা দেখি, প্রথম হাফে একটি পক্ষ যেই পাশে খেলেন, বিরতির পর দ্বিতীয় হাফে তাহার উলটা পাশে তাহাদের গোলপোস্ট পড়ে। তাহারও অন্যতম কারণ—লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। কোনো পক্ষ যাহাতে মাঠের অতিরিক্ত সুবিধা না পায় তাহার সকল ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এখন ভোটের মাঠে যদি দেখা যায়, কোনো পক্ষ সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ভিতর দিয়া নিজেদের ভোট সুরক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করিতেছে, তাহা হইলে সেইখানে আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকে না। বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করিয়া বুঝিয়া দেখা যাক।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জন্য দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া কিংবা অসুরক্ষিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারপ্রধান নিঃসন্দেহে মানবিক ও দরিদ্রবান্ধব। দেশে বর্তমানে বয়স্কভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৫৮ লক্ষ ১ হাজার। এখন জনপ্রতি ৬০০ টাকা হারে বয়স্কভাতা দিতেছে সরকার। নূতন করিয়া আরো ৬ লক্ষ ৯৯ হাজার বয়স্ক ব্যক্তিকে এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনিবার প্রস্তাবনার কথাও জানা গিয়াছে। দেশে বর্তমানে ২৫ লক্ষ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা সুবিধাভোগী সরকারি কোষাগার হইতে মাসে ৫৫০ টাকা হারে ভাতা পাইতেছেন। এইখানেও সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরো ৭ লক্ষ বাড়াইয়া ৩২ লক্ষ ৭৫ হাজার করিবার প্রস্তাব করা হইয়াছে। ইহা ছাড়াও দেশে বর্তমানে ২৯ লক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সরকারি ভাতা পাইতেছেন। সরকার ১০ মূল সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় ১ কোটি ৩৯ লাখ উপকারভোগীর জন্য ৪৩ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখিয়াছে। সার্বিকভাবে সরকার প্রায় ১৩০টি কর্মসূচির আওতায় নিরাপত্তাবেষ্টনী সুবিধা দিতেছে।

এই সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যানচিত্রে আমরা দেখিতে পাইলাম, মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৩৯ লক্ষ। অর্থাত্ প্রায় ১০ হইতে ১২ শতাংশ ভোটার এই উপকারভোগীর তালিকায় রহিয়াছেন। এখন কোনো একটি উপজেলা পর্যায়ে যদি মেয়র, চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা প্রভাবশালীরা এই সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের উপকারভোগীদের কার্ড জমা রাখিয়া ব্ল্যাকমেইল করেন যে, তাহাদের প্রার্থীকে ভোট না দিলে এই শ্রেণির উপকারভোগীরা সামাজিক সুরক্ষার অর্থ পাইবেন না, তখন ঐ শ্রেণির লোক বাধ্য হয় প্রভাবশালীদের পক্ষের প্রার্থীকেই ভোট প্রদান করিতে। এমতাবস্থায়, ঐখানে আর ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকে না। বর্তমানে অনেক এলাকায় নির্বাচনের আগেই এই সকল ভাতার কার্ড জমা নেওয়া হইতেছে এবং ভোট শেষে পছন্দীয় প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার প্রমাণ সাপেক্ষে সেই কার্ড ফেরত দেওয়া হইতেছে। একটি নির্বাচনে যেইখানে এক-আধ শতাংশ ভোট বহু ক্ষেত্রে জয়পরাজয় নির্ধারণ করিতে পারে, সেইখানে ১০/১২ শতাংশ ভোটার যদি পূর্বেই কাহারো পকেটে ঢুকিয়া যায়, তাহা হইলে সেই পক্ষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ভোটে শুরুতেই অগ্রগামী থাকে। কারণ, একটি ভোট প্রতিপক্ষ না পাইয়া নিজে পাইলে উহা দ্বিগুণ ভোট হইয়া যায়। তাই সরকারি ভাতার এইরূপ দলীয়করণ কাম্য নহে।

সুতরাং সরকারের ভালো কাজগুলিও কোথাও কোথাও খল লোকেরা নিজেদের ভোট ব্যাংক ও স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করিতেছে। এই ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার সকল কার্যক্রম চেয়ারম্যানদের পরিবর্তে সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পরিচালিত হইলে ইহার অপব্যবহার হ্রাস পাইতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের কেহ কেহ যে দলবাজির পাশাপাশি দুর্নীতি করেন না কিংবা টাকা খাইয়া একটি বিশেষ পক্ষের হইয়া কাজ করেন না, তাহা নহে। তবে ইহা মন্দের ভালো। মূল কথা হইল, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক রাখা। উহা নষ্ট হয়, এমন যে কোনো বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ লইতে হইবে। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম যেন কাহারো ফিক্সড ভোট তথা ভোট সুরক্ষা কার্যক্রমে পরিণত না হয়।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন