প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবীর। জলবায়ুর ভয়াবহ অভিঘাতে বিপর্যস্ত আমাদের জীবনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি কৃষি, প্রকৃতি ও পরিবেশে পরিবর্তন আসছে। বিশ্বের জলাভূমির ৭০ শতাংশ ইতিমধ্যে মরুকবলিত হয়ে পড়েছে, যার পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত নিরাপত্তা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের ওপর মরুকরণ ও খরার মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, পৃথিবীর প্রায় দেড় শ কোটি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ক্ষয়িষ্ণু ভূমির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর অতি দরিদ্রদের ৪২ ভাগই বাস করে ক্ষয়ে যাওয়া এলাকায়, যারা মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। এই ভূমিক্ষয় জলবায়ু পরিবর্তনকে আরো ত্বরান্বিত করেছে, যা শুধু আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই বিপদের কারণ নয়, বরং এটি আমাদের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
ভূমির অবনমন ও জলবায়ু পরিবর্তন খরার আগমন ত্বরান্বিত করছে। খরাপীড়িত ও অবনমিত ভূমিতে মরুকরণ প্রক্রিয়ার শুরু। মরুকরণ ও খরা বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই পরিবেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। নিষ্কাশনে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলীয় এলাকার ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের নিচু উপকূলীয় অঞ্চল অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসারণ হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে শতাব্দী শেষে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী বড় ভূখণ্ড সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিক্ষয়, যশোর জেলায় জলাবদ্ধতা এবং দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে এসব জায়গায় ভূমির অবনমন ঘটছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিনে দিনে আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে গাছপালা, বন-জঙ্গল। শুকিয়ে যাচ্ছে নদীগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। অতি সম্প্রতি বিখ্যাত স্প্রিঞ্জার গ্রুপের একটি জার্নালে (আর্থ সিস্টেম অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, ডিসেম্বর ২০২৩) প্রকাশিত প্রবন্ধে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে খরার তীব্রতা, পৌনঃপুনিকতা ও পরিবর্তনশীলতা বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, আমাদের দেশও মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০। এর মধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা ১১৭টি। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিইউএস) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাধারণ হিসাবে গত ৪০ বছরে শুধু তিনটি প্রধান নদী—পদ্মা, মেঘনা, যমুনাতেই এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বে এবং বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষির ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলছে, যা খরা শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়। কিছু এলাকায় খরার পাশাপাশি বন্যা ও ভাঙন বাড়তে পারে। খরা পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশে জলবায়ুর একটি পুনরাবৃত্ত বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘকালীন শুষ্ক আবহাওয়া ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে খরা অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের পরিমাণ বৃষ্টিপাতের চাইতে বেশি হলেই এমনটি ঘটে। খরার ফলে উদ্ভূত ধূলিঝড় ও অগ্নিকাণ্ডের কারণে প্রায়ই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রাচীন বহু সভ্যতার পতনের সঙ্গে খরার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
জাতিসংঘের জলবায়ুসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনো যেভাবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসারণ হচ্ছে, তাতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ শিল্পবিপ্লব শুরুর সময়ের তুলনায় অন্তত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে আর ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৭ থেকে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে আরেকটু দীর্ঘ মেয়াদে। তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো বেশি করে গলে বিপর্যয়কর বন্যার মুখোমুখি হবে এর পাদদেশের দেশগুলো। ভাটিতে থাকায় আমাদের ক্ষতি হবে বেশি। সম্ভাব্য এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অবিলম্বে অবনমিত (ক্ষতিগ্রস্ত) ভূমি পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। এটাকেই জাতিসংঘ সবচেয়ে উত্তম সমাধান বলে চিহ্নিত করেছে।
বিশ্বের সর্ববৃহত্ মরুভূমি সাহারা। গত শতাব্দীতে এই মরুভূমি ১০ শতাংশেরও বেশি প্রসারিত হয়েছে, যার বর্তমান আয়তন ৩৩ লাখ বর্গমাইলের বেশি। এটি এখন উত্তর আফ্রিকার ১১টি দেশে বিস্তৃত। আধা শুষ্ক সাহেল অঞ্চল দক্ষিণের এলাকাগুলোর জন্য একটি বাফার জোন হিসেবে কাজ করে। এই অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরই মধ্যে পানি স্বল্পতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মাটির গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং উদ্ভিদের অভাব মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম ভাগে এবং বর্তমান পাকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে বালুকাময় থর মরুভূমি অবস্থিত। এই মরুভূমি সিন্ধু উপত্যকায় বহু দূর প্রবেশ করেছে, যেখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২ সেন্টিমিটারের কম। জাতিসংঘের হিসাবে, এ ধরনের জমির ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ভূমি পুনরুদ্ধারই সবুজ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে পারে। মরুকরণ রোধে রাস্তার ধারে বৃক্ষরোপণ, উপকূলীয় বনায়ন এবং সামাজিক বনায়ন হচ্ছে বাংলাদেশের সফল ভূমিভিত্তিক অভিযোজন কার্যক্রমের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেসব বৃক্ষ পানি ধরে রাখে এবং জমির মান অক্ষুণ্ন রাখতে পারে, সেসব বৃক্ষ রোপণ করার ব্যাপারে পরিবেশবিজ্ঞানীরা সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেক উদ্ভিদ প্রজাতির খরা সহনশীলতা অভিযোজন আছে, যেমন—পাতার ক্ষেত্রফল কমে যাওয়া এবং খরা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়াতে মোমযুক্ত কিউটিকল। দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা, মরুকরণ প্রতিরোধ এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ও বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। মরুকরণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ ইউএনসিসিডি সচিবালয়ের পাশাপাশি গ্লোবাল মেকানিজমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমর্থন প্রয়োজন।
মরুকরণের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার বড় অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নথিভুক্ত ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘায়িত খরা চিলির আতাকামা মরুভূমিতে হয়েছিল। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি উপসাহারীয় আফ্রিকায় খরার কারণে প্রায় ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনের পর মরুকরণসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সচেতন দেশগুলো ভূমি সংরক্ষণে বনায়ন, কৃষি বনায়ন, সোপান পদ্ধতিতে চাষাবাদব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছে। বালু ধরে রাখার জন্য ডান ফিক্সিং পদ্ধতি অনুসরণ এবং পানি সরবরাহব্যবস্থা সচল রাখতে নেওয়া হয়েছে নলকূপ খনন ও সেচব্যবস্থা প্রণয়নের পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ সরকার ভূমিক্ষয় ও মরুকরণ প্রতিরোধে জাতীয় পরিবেশনীতি সংশোধন করেছে এবং মরুকরণ, ভূমি অবক্ষয় ও খরা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাকশন প্রোগ্রাম ২০১৫-২০২৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা ২০২৩-২০৫০ প্রণয়ন করেছে। এটা সঠিকভাবে বস্তবায়ন করা হলে তা মরুকরণের বিস্তার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
সম্প্র্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্ফান, ফণী, সিডর, আইলা, নার্গিস ও রেমালসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মরুকরণের ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের উত্সাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পানিপ্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। খরাপীড়িত উত্তরাঞ্চলে খরাসহিষ্ণু ফসল চাষে উত্সাহ প্রদানসহ সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা জরুরি। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে পদ্মা ও তিস্তার পানি কৃত্রিম জলাধারে রেখে শুষ্ক মৌসুমে তা ব্যবহারের চিন্তা করা যেতে পারে।
মরুকরণ ও খরাজনিত কারণে আগামী দশকে বিশ্বের নানা জায়গায় প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে বলে জাতিসংঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর জমি হারাচ্ছে, যা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ উপকূল রয়েছে, যেখানে জোয়ারের পানির সংস্পর্শে লবণাক্ততা বাড়ছে। এজন্য ভূমির অবক্ষয় তথা মরুকরণের বিস্তার রোধ জরুরি হয়ে উঠেছে। খরা ও ভূমির অবনমন মোকাবিলায় নিবিড় গবেষণা একান্তভাবে প্রয়োজন; সেই সঙ্গে প্রয়োজন জনসচেতনতা।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট