দ্রব্যমূল্যস্ফীতিতে জনজীবন এখনো অস্থির। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ক্রমাগত অব্যাহত থাকার এই সময়ে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উত্সব ঈদুল আজহা এসে দরজায় কড়া নাড়ছে। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে দক্ষিণবঙ্গের যেসব ক্ষুদ্র চাষি ধারদেনা করে ছোট ছোট গরু-ছাগলের খামার গড়ে আগেকার সমুদ্রঝড়গুলোর ক্ষতি মোকাবিলার জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন, তারা এ বছর রেমালের আঘাতে আবারও কুপোকাত হয়ে এখন দিবাস্বপ্ন দেখছেন। তাদের পোষা গরু-ছাগল-ভেড়া পানিতে ভেসে গেছে, মরে গেছে, নয়তো অসুস্থ হয়ে এবারের কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। গরু-ছাগল লালন পালন করে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রচেষ্টা এবার তাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে পড়েছে।
রেমাল-আক্রান্ত হয়ে বেঁচে যাওয়া অসুস্থ বা সুস্থ পশুগুলোকে তারা অনেকেই গোখাদ্যের অভাবে স্বল্পদামে ইতিমধ্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে মাঠের প্রাকৃতিক ঘাস মরে পচে গোখাদ্যের চরম অভাব দেখা দিয়েছে। হাতে টাকাও নেই বাজার থেকে দামি গোখাদ্য কেনার। তার ওপর বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে উজানের ঢলে হঠাত্ বারবার অকালবন্যার তাণ্ডবকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এজন্য কোথাও জীবনের ছন্দ নেই, কোথাও স্বস্তি নেই।
অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারীরা সুযোগ বুঝে অতি মুনাফা লাভের আশায় আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এসব মজুতদার, শঠ ও লোভী ব্যবসায়ীকে হীনকর্ম ঠেকানোর জন্য তদারকি সংস্থাগুলো গত মাস থেকে কদিন গরম গরম কথা বলে ভুক্তভোগী মানুষকে আশার বাণী শোনালেও তারা এখন সবাই চুপ হয়ে গেছেন। বিশেষ করে, সমুদ্রঝড় রেমাল আঘাত হানার পর থেকে বাজারের বেসামাল অবস্থার জন্য কেউ কেউ এই ঝড়কেই দায়ী করে নিজের দায় সারার চেষ্টা করছেন!
কোরবানির ঈদের বাজারে ইতিমধ্যে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে ২-৩০০ শতাংশের ঘরে পৌঁছেছে। রেমাল-আক্রান্তরা এ বছর পশু কোরবানি দিতে পারবেন কি না এবং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কোরবানির মাংসের নাগাল পাবেন কি না তার কোনো হদিস নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে মাংস রান্নার অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ মসলার বাজার তেতে আগুন হয়ে উঠেছে। এক জাতীয় পত্রিকার সংবাদ শিরোনামে লেখা হয়েছে—রসুনের দাম বেড়েছে ৩১০ শতাংশ। আদা ২০৬ শতাংশ, পেঁয়াজ ১৬৭ শতাংশ, চিনি ১৫২ শতাংশ। গরম মসলার বাজার প্রতিদিন আরো বেশি গরম হয়ে তেতে উঠছে। কাঁচাবাজারের এসব আমদানি করা পণ্যসামগ্রীর দাম কেন প্রতিদিন বাড়ে তার কোনো যুক্তি বিক্রেতারা কেউ দিতে পারেন না। বিদেশ থেকে বহু আগে এলসি খুলে আমদানি করা এসব নিত্যপণ্যের দামের সঙ্গে সম্প্রতি আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘটে যাওয়া সমুদ্রঝড় রেমালের সম্পর্ক কী? সে কথা জিগ্যেস করলে বিক্রেতারা ফ্যালফ্যাল করে ক্রেতার দিকে তাকিয়ে নিরুত্তর থাকেন অথবা বিরক্ত হয়ে ওঠেন।
আসলে বাজারের দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে যাদের জিহ্বা অতি লম্বা হয়ে গেছে তারা কোনো দিন কোনো শাস্তিকে ভয় করেন না। ইহকালেরও না, হয়তো পরকালের শাস্তিটাকেও নয়। পরকালেরটা না হয় অদেখা ও অতিদূরের, তাই এখন উপলব্ধিতে আসে না। কিন্তু ইহকালের শাস্তি তাদের দেওয়ার কেউ কি আছেন? তারা জরিমানাকে ভয় করেন না। জেল খাটারও ভয়-ডর তাদের মনে জাগে না কখনো। কারণ, তারা আজকাল ‘বরেরও মাসি, কনেরও পিসি’! এই নীতিতে অভ্যস্ত হওয়ার সুবাদে আমাদের দেশে সুবিধাবাদী শ্রেণির অভ্যুত্থান ঘটেছে সাড়ম্বড়ে। বড় বড় অপরাধীরা এই ধরনের সুবিধায় আস্কারা পেয়ে মাথায় উঠে পড়েছে। ভয়ংকর ও মেগা অপরাধীরা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সম্প্রতি কিছু বড় বড় ঘটনা ও মেগা দুর্নীতির চিত্র থেকে এ কথা আরো বেশি স্পট হয়ে ওঠে। সাধারণ জনমনে উত্কণ্ঠা বেড়ে গেছে বহু গুণ।
কিছু বিত্তশালী মানুষ এমনই বেসামাল হয়ে পড়েছেন যে, তারা দরিদ্রদের জন্য প্রেরিত সাদাকার ওপর লোভ সংবরণ করতে পারছেন না। প্রতি বছর কোরবানির ঈদের পর সৌদি আরব থেকে আমাদের দেশের দরিদ্রদের জন্য সাদাকা স্বরূপ সাদাকার মাংস পাঠানো হয়ে থাকে। প্রতি বছর ৭০-৮০ হাজার বাংলাদেশি হাজিদের দেয়া কোরবানির পশুর মাংসের সঙ্গে আরো বিভিন্ন দেশের হাজিদের দেওয়া কোরবানির পশুর মাংসের বিরাট চালান আমাদের দেশে বিনা ভাড়ায় জাহাজ ভর্তি করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সেসব সাদাকার মাংসে ভাগ বসান আমাদের দেশের একশ্রেণির ধনাঢ্য ব্যক্তি।
কোরবানির আগে সৌদি সরকার নিজেদের পশু কম থাকায় ইয়েমেন, সুদান, মিশর, কেনিয়া, ইথিওপিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে উট, দুম্বা, ছাগল আমদানি করে থাকেন। তাই সেসব মাংস সৌদি আরবের পবিত্র মাংস ভেবে অনেকে নিজেরা ভাগাভাগি করতে উদ্ধত হয়ে পড়েন। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা, ইউপির মেম্বার, চেয়ারম্যান ও তাদের অনুসারীরা তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। ফিবছর কয়েক বার ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগের সঙ্গে দুর্ভোগও তাই ফিরে ফিরে আসে। শুধু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যে প্রাকৃতিক বিপদ মোকাবিলা করা যায় না, সেটা মৃদু রেমালের ক্ষয়ক্ষতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সমুদ্রঝড় রেমাল মানব প্রাণসংহারী ভূমিকায় ততটা অবতীর্ণ হতে না পারলেও গবাদি পশুপাখি, কৃষি ও চিংড়ি খামারিদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সীমিত আয়ের ভিত্তিতে খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ে সর্বোচ্চ ব্যয় বাংলাদেশে লক্ষণীয়। অথচ, দেশে অতিধনী বেড়েছ ১৭.৩ শতাংশ। চীনে ১৩.৪ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১২.৭ শতাংশ, ভারতে ১০.৭ শতাংশ। সর্বগ্রাসী দুর্নীতির আবহে যেটা আমাদের কৃষ্টিতে ইতিমধ্যে গভীরভাবে জেঁকে বসেছে সেটার মূলোত্পাটন কি খুব সহজ?
ঈদুল আজহা আসছে। এমন সময় যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আছেন, তাদের দিকে সম্মিলিত দৃষ্টি প্রদান জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির দুর্যোগে যারা নিপতিত ও নিষ্পেষিত, তাদের কথাও চিন্তা করতে হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন