মানবেতিহাসের সবচাইতে নির্বাচনি বত্সর হইল ২০২৪ সাল। কারণ এই বত্সর ৬০টির বেশি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের নির্বাচন সম্পন্ন হইয়াছে। যেমন ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রাশিয়া প্রভৃতি। এই সকল নির্বাচন লইয়া দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এক বিশ্লেষণ প্রকাশ করিয়াছে। তাহাদের ভাষ্য অনুযায়ী অধিকাংশ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাইতেছে যে, কর্তৃত্ববাদী শাসকরা ধাক্কা খাইতেছেন। কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলির জন্য এই সকল নির্বাচন চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা দিয়াছে। ভোটাররা যেইখানে সুষ্ঠুভাবে ভোট দেওয়ার ও বিকল্প প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ লাভ করিতেছেন, সেইখানে তাহারা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছেন না। ইহাতে কেহ কেহ পুনরায় ক্ষমতায় আসিলেও আগের তুলনায় পাইয়াছেন কম ভোট। কেহ-বা আবার হারাইয়াছেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ফলে তাহাদের জোটনির্ভরতা বাড়িয়াছে। বিশ্লেষকরা মনে করিতেছেন, ২০২৪ সাল হইবে গণতন্ত্রের জন্য অগ্নিপরীক্ষাস্বরূপ। ইহাতে বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার আবার ক্ষমতায় আসিতে ব্যর্থ হইতে পারে।
শত হতাশার মধ্যে ইহা একটি আনন্দদায়ক সংবাদই বটে। দেখা যাইতেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ন্ত্রণে লইয়াও কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা সাফল্য লাভ করিতেছেন না। জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিতেছে ব্যালটে। গণতন্ত্রকামী মানুষ ও বিশ্বের জন্য ইহার চাইতে সুখবর আর কী হইতে পারে? সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনে গত ৩০ বত্সরের মধ্যে এই প্রথম প্রতিষ্ঠিত শাসক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আধিপত্য খর্ব হইয়াছে। তাহারা নির্বাচনে হারাইয়াছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। মেক্সিকোতে ক্ষমতাসীন আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজকে পরাজিত করিয়া ভূমিধস বিজয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াছেন জলবায়ুবিজ্ঞানী ক্লডিয়া শেনবাউম। তিনি দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। ভারত ও তুরস্কে যাহাদের অপরাজেয় নেতা হিসেবে মনে করা হইত, নির্বাচনি ফলাফলে তাহারাও পিছাইয়া পড়িয়াছেন। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের এখন ধর্মনিরপেক্ষ দলের সহিত জোট করিয়া সরকার গঠন করিতে হইতেছে। তুরস্কের বিরোধীরা গত এপ্রিলে দীর্ঘদিন ধরিয়া ক্ষমতায় থাকা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছেন। স্থানীয় নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে ইস্তাম্বুল ও রাজধানী আঙ্কারার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ লইয়াছেন। তবে রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসক ভ্লাদিমির পুতিন গত মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৮৮ শতাংশ ভোট পাইয়া আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইলেও ভোটের এই হিসাব আসলে রাশিয়ার জনসাধারণের অনুভূতির সঙ্গে যে মিলে না, তাহা বলাই বাহুল্য।
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ভোটারদের কেন এই ক্ষোভ? বিশ্লেষকরা বলিতেছেন, বিগত বত্সরগুলিতে জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর অনেক শাসক সীমা লঙ্ঘন করিয়াছেন। তাহারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উত্তরোত্তর বিকাশ ও উন্নয়নের বদলে তাহা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করিয়াছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন লইয়া সন্দেহের বীজ বপন করিয়াছেন। এমনও দেখা যায় যে, নির্বাচনের আগেভাগে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাহার সমর্থক নেতাকর্মীদের ওপর ধরপাকড় চালানো হয়। তাহাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও সাজানো মামলা দিয়া হেনস্তা করা হয়। নির্বাচনে জয়লাভ করিতে রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির অপব্যবহার চলে। এই সকল অপব্যবহার করিয়াও অনেকের রক্ষা হয় নাই। এই ব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বেন আনসেল বলিয়াছেন যে, গণতান্ত্রিক দেশের শাসক দলগুলি যাহা চায় নাই, এমন ফলাফল আসিয়াছে নির্বাচনে। জটিল অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে অস্থিতিশীল হইয়া পড়ায় কর্তৃত্ববাদীদের মতো আচরণ করিয়াও তাহারা রক্ষা পান নাই। অব্যাহত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী বেকারত্ব ও অসম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি—ভোটারদের বিক্ষুব্ধ হইবার এই সকলই মূল কারণ। যে কারণে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে ধর্মীয় জুজুর ভয়ের চাইতে ভোটাররা অর্থনীতিকেই প্রাধান্য দিয়াছেন। অযোধ্যায় ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি কি তাহারই ইঙ্গিতবহ নহে?
প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র হইল স্টেট অব মাইন্ড। এই জন্য আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘ইফ উই ওয়ান্ট ডেমোক্রেসি টু ফ্লারিশ, উই উইল হ্যাভ টু ফাইট ফর ইট। উই উইল হ্যাভ টু নার্চার ইট। অ্যান্ড উই উইল হ্যাভ টু ডেমোনস্ট্রেইট ইটস ভ্যালু।’ অর্থাত্ গণতন্ত্রকে বিকশিত ও শক্তিশালী করিতে হইলে আমাদের এই জন্য নিরন্তর লড়াই করিয়া যাইতে হইবে। ইহার প্রতি যত্নবান হইতে হইবে এবং ইহার মূল্যবোধ প্রতিপালন করিয়া যাইতে হইবে। আমরা যদি এই হিতোপদেশ মানিয়া চলি এবং অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াই, তাহা হইলে কোনো দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবে না।