শান্তির পক্ষে ইউক্রেন সব সময়ই সোচ্চার। শান্তি সর্বদা ন্যায্য, ব্যাপকতর ও দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে—শুরু থেকেই এমনটাই দাবি কিয়েভের। এসব মানদণ্ড পূরণের নিরিখে শান্তিপ্রক্রিয়াকে অবশ্যই জাতিসংঘ সনদের বিধান, আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম ও মূলনীতির সঙ্গে সদৃশপূর্ণ হতে হবে।
২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনের সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একটি ‘শান্তি প্রক্রিয়া (পিস ফর্মুলা)’ উপস্থাপন করেছিলেন। ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর জন্য প্রয়োজনীয় নানামুখী পদক্ষেপের প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঐ পিস ফর্মুলায়। এরপর বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসি আমরা। এভাবে একসময় গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হই। এই পটভূমিতে আগামী ১৫-১৬ জুন সুইজারল্যান্ডের বার্গেনস্টকে এক ‘পিস সামিট’ (শান্তি সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ১৬০টির বেশি দেশ ও প্রতিষ্ঠানকে ঐ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান এবং ইউরোপের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগদান করবেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে, এমন দেশের তালিকায় রয়েছে—বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জর্জিয়া, জার্মানি, ইতালি, লাটভিয়া, লিচেনস্টাইন, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন এবং আফ্রিকার কেপ ভার্দে ও মালাউয়ের নাম। এশিয়া থেকে ভারত, জাপান, ফিলিপাইন, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া অংশগ্রহণ করবে বলে নিশ্চিত করেছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আর্জেন্টিনা ও চিলি এবং উত্তর আমেরিকা থেকে কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মেলনে জড়ো হবে। এছাড়া উপস্থিত থাকবেন ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রধানরা এবং ইউরোপীয় কমিশন।
সম্মেলনে চীন অংশগ্রহণ করবে কি না—তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। রাশিয়াকেও সম্মেলনে খুঁজে পাওয়া যাবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। এমতাবস্থায় সুইস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো তথা, উন্নয়নশীল বিশ্ব এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলো রাশিয়াকে শেষ পর্যন্ত এই শান্তি প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে, এই শান্তি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষানিরীক্ষা করছে বেইজিং। অবশ্য জেলেনস্কি সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য চীনের নেতা শি জিনপিংকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন, যা একপ্রকার নিশ্চিত। আসন্ন নির্বাচনের প্রচারণা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পিস সামিটে থাকতে পারবেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এ পিস সামিটের উদ্দেশ্য হলো, ইউক্রেনের ‘১০ দফা শান্তি প্রস্তাবের’ ওপর বিশেষ আলোকপাত করা এবং পরবর্তী সময়ে শান্তি প্রক্রিয়ায় ইউক্রেন ও রাশিয়াকে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে একটি যৌথ পরিকল্পনা তৈরি করা। যদিও এই মহত্ উদ্দেশ্য মস্কো পণ্ড করার পাঁয়তারা করেছিল বা করছে! ইউক্রেনের পক্ষ থেকে সম্প্রতি অভিযোগ করা হয়, এ শীর্ষ সম্মেলন ব্যাহত করার জন্য ‘একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা’ আঁটার চেষ্টা করেছিল রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ আছে, যেসব রাষ্ট্র সামিটে অংশগ্রহণ করার কথা ভাবছে, তাদের সামিটে অংশ নেওয়া থেকে নিরুত্সাহিত করার পরিকল্পনা রয়েছে মস্কোর।
যাহোক, এই শীর্ষ সম্মেলনে মোটা দাগে তিনটি অন্তর্ভুক্তিমূলক লক্ষ্যের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে। প্রথমত, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা বলা এবং পারমাণবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা; দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণসাগর (ব্ল্যাক সি) ও আজভ সাগরে নির্বিঘ্নে নৌ চলাচলের নিশ্চয়তা নিয়ে কথা বলা, যাতে করে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা সুরক্ষিত হয় এবং তৃতীয়ত, বন্দি বিনিময় এবং অবৈধভাবে আটক, নির্বাসিত ও বাস্তুচ্যুতদের ইউক্রেনে ফেরানো এবং এ সংক্রান্ত মানবিক সমস্যা সমাধানে রূপরেখা তৈরি করা।
মূলত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সংগতি রেখে এবং এর ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখা সাপেক্ষে এ সম্মেলনে গোটা বিশ্বকে একত্রিত করার চেষ্টা করে আসছি আমরা। জাতিসংঘ সনদ মেনে চলে এবং বিশ্বশান্তি কামনা করে—এমন প্রতিটি দেশকে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে ইউক্রেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে একটি বিকশিত শান্তি কাঠামোর সহযোগিতায় ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করা এবং এই কাঠামোকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বাধ্যতামূলক আইনি উপাদানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা থাকবে। অর্থাত্ এই সম্মেলন একটি সত্যিকারের শান্তি প্রক্রিয়ার ভিত্তি রচনা করবে বলে ধরে নেওয়া যায়। লক্ষণীয়, সম্মেলনে বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে, যা বিশ্ববাণিজ্য তথা, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক। একই সঙ্গে অবৈধভাবে আটক শিশুসহ বেসামরিক মানুষদের মুক্তির জন্য আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। মানবিক এই উদ্যোগ বিশ্বশান্তির জন্য সত্যিকার অর্থেই অনেক বেশি জরুরি আজকের দিনে।
এই শান্তি সম্মেলনে এমন যৌথ শান্তি কাঠামো বিনির্মাণ করার চেষ্টা থাকবে, যাতে করে বিশ্বব্যাপী চলমান অন্যান্য দ্বন্দ্ব সমাধানে তা ব্যবহার করা যায়। যুদ্ধ-সংঘাতে ভুক্তভোগী বিভিন্ন দেশ এ থেকে বেশ উপকৃত হতে পারে। অর্থাত্ দীর্ঘস্থায়ী নানা সমস্যা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে এক অনন্য সুযোগ এনে দেবে এই সম্মেলন।
সম্মেলনকে সামনে রেখে সৌদি আরবের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা বা পুনরুদ্ধারে ইউক্রেনকে সব সময়ই দৃঢ়ভাবে সমর্থন করা রিয়াদ এই সম্মেলনে তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কোপেনহেগেন, জেদ্দা, মালটা ও দাভোসে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংলাপগুলোতে সৌদি আরবের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই ধারাবাহিকতায় সুইজারল্যান্ডে সৌদি কিংডমের সরব উপস্থিতি একান্তভাবে কাম্য। বিশ্বাসযোগ্যতার দাবিদার সৌদিকে আমরা সব সময়ই অন্যতম ‘প্রভাবশালী শক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করি। ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যে জটিল কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়, তাতে সৌদি সরকারের সবিশেষ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশকে এক্ষেত্রে সম্পৃক্ততার বিষয়ে রিয়াদের অনেক কিছু করার আছে। সৌদি আরবের আন্তরিক নেতৃত্বই এক্ষেত্রে মূল বিষয়।
বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য শীর্ষ সম্মেলন বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব বহন করবে নিঃসন্দেহে। এই অবস্থায় সবার উচিত হবে, সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা এবং সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ‘সুইজারল্যান্ড পিস সামিট’ অনুকরণীয় হয়ে উঠবে বলে নিশ্চিয়তা রইল।
লেখক: সৌদি আরবে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত
আরব নিউজ থেকে অনুবাদ:সুমৃত খান সুজন