বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১
The Daily Ittefaq

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৌন্দর্য

আপডেট : ১১ জুন ২০২৪, ০৭:৩০

সদ্য সমাপ্ত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে বুথফেরত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, উগ্র ডানপন্থিদের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করিয়াছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ। ইহার পর গতকাল আকস্মিক এক ঘোষণায় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভাঙিয়া দিয়া আগামী ৩০ জুন ও ৭ জুলাই দুই দফায় দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে বলিয়া ঘোষণা দিয়াছেন তিনি। বুথফেরত জরিপ প্রকাশের পর এক ভাষণে উগ্র ডানপন্থি নেতা জর্ডান বারডেলা ম্যাক্রঁকে ফরাসি পার্লামেন্ট ভাঙিয়া দেওয়ার আহ্বান জানাইয়া দুই দলের ভোটের ব্যবধানকে ‘প্রেসিডেন্টের জন্য হতাশাজনক’ বলিয়া অভিহিত করেন। এমন বক্তব্যের মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ম্যাক্রঁ উক্ত ঘোষণা দেন, যখন প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাহার মেয়াদ আরো তিন বছর বাকি রহিয়াছে। গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্য মূলত এইখানেই, যাহা আমরা বিশেষ করিয়া উন্নত বা অগ্রসরমাণ বিশ্বে প্রত্যক্ষ করিয়া থাকি। লক্ষণীয়, জনগণ প্রেসিডেন্ট বা তাহার দলের বিপক্ষে মতামত দিয়াছে এবং বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ তাহার যোগ্যতা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছে— এতটুকুতেই স্বেচ্ছায় সরিয়া যাইতেছেন নেতা, যেইখানে নুতন মেয়াদে ক্ষমতায় আসার প্রশ্নে তাহার সামনে রহিয়াছে ঝুঁকি। এই বাস্তবতা ম্যাক্রঁ নিজেও জানেন, কিন্তু তাহার পরও দেশ ও জাতির রায়ই তাহার নিকট শেষ কথা। জাতির উদ্দেশে ম্যাক্রঁ বলিয়াছেন, ‘আমার সিদ্ধান্তটি গুরুতর। কিন্তু ইহার মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা এবং সার্বভৌম জনগণের মতামত প্রকাশের বিষয়টির প্রতিফলন ঘটিল। ইহাকে আমি জাতির জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা বলিয়া মনে করি।’ ম্যাক্রঁ বলিয়াছেন, ‘আমি আপনাদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে আপনাদের সংসদীয় ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত ফিরাইয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়াছি।’

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মূলত জনগণের ভোটাধিকার তথা জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। আর এই জনমত যাচাইয়ের প্রধান নিয়ামক হইল অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এই সংস্কৃতি প্রভূত উন্নতি লাভ করিয়াছে অনেক রাষ্ট্রে—যেমন ব্রিটেনে। বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে পদত্যাগ করিতে দেখা গিয়াছে। তাহার পূর্বে তেরেসা মে ও বরিস জনসনও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাহাদের মেয়াদপূর্তির পূর্বেই বিতর্কের পর পদত্যাগ করেন বা করিতে বাধ্য হন। সারকথা হইল, ২০১৯ সালের পর হইতে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক পর্যন্ত মাত্র চার বছরের মধ্যে চার জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, কিন্তু শুধু জনগণের ম্যান্ডেটকে শ্রদ্ধা করিয়াই তিন জন স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়িয়া দিয়াছেন। অর্থাত্ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং মূল্যবোধ সমুন্নত রাখিবার প্রশ্নে তাহারা আপস করেন নাই। যখনই প্রয়োজন হইয়াছে, তখনই তাহারা ক্ষমতা হইতে সরিয়া গিয়াছেন; কেহই ক্ষমতা আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকিবার ইচ্ছা পোষণ করেন নাই। গণতন্ত্রের আসল শিক্ষা ইহাই।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতার যুগে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা হিসাবে ‘গণতন্ত্র’ নবযাত্রা শুরু করে। বর্তমান সময়ের ন্যায় আগামী দিনগুলির জন্যও গণতন্ত্র সবচাইতে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা, যাহা লইয়া সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নাই। তবে সাম্প্রতিক বত্সরগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান সংকট অধিক দৃষ্টিগোচর হইতেছে। বিগত এক দশকে বিশ্ব জুড়িয়া বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেন অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে! অনেক দেশেই জটিল রূপ নিয়াছে গণতন্ত্রচর্চার প্রেক্ষাপট। গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন বলিতে যাহা বোঝায়, এই সকল দেশে তাহা প্রায়ই উপেক্ষিত হইতেছে। বরং গণতন্ত্রের নামে এই সকল ভূখণ্ডে স্থান করিয়া নিয়াছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা, গণবিরোধিতা, কর্তৃত্ববাদ, রাজনৈতিক সহিংসতা ও আত্মপূজাসহ নানাবিধ বিষয়, যাহা সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতা। সরকারগুলির এহেন গণতন্ত্রমনস্কতার অভাব ও আত্মকেন্দ্রিকতা তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সম্মুখে মারাত্মক সংকট দাঁড় করাইয়া দিতেছে। কতিপয় আদর্শ গণতন্ত্রিক দেশও এই তালিকার বাহিরে নহে। উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এই সকল দেশে গণতান্ত্রিক স্পেস ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। গণতন্ত্রপ্রিয় ও শান্তিকামী মানুষের জন্য এই প্রবণতা দুশ্চিন্তার কারণ বটে।

‘ডেমোক্রেসি ইজ আ স্টেট অব মাইন্ড’ তথা গণতন্ত্র মানসিক ব্যাপার—গণতন্ত্রের আধুনিক সংজ্ঞা ইহাই। জনগণের স্বার্থই এইখানে প্রধান ও প্রথম। যদিও উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইহার চর্চা নাই। সেইখানকার ক্ষমতাসীনরা সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও চরম বিতর্ক-সমালোচনা এবং কঠিন আন্দোলন, সংগ্রাম, রক্তারক্তির পরও ক্ষমতা আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকিতে চাহেন। ইহা জনগণের শাসন তথা গণতন্ত্রের পথে যে বড় অন্তরায়, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।

 

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন