ন্যাশনাল সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুন নাহার লাকি বলেছেন, নিম্নতম স্তরে কোন বিদেশি ব্র্যান্ড আমরা অনুমোদন করব না। এটা শুধুমাত্র দেশি শিল্পের জন্য দেশি ব্র্যান্ডের জন্য রিজার্ভ থাকছে। ২০১৮-১৯ সালের বাজেট অধিবেশনে দেশীয় কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন সুপারিশ করা হয়েছিল, বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট শুধুমাত্র মধ্যম এবং উচ্চ স্তরে তৈরি করা যাবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বৈরাচারী মনোভাব, মনোপলি বাণিজ্যনীতি ও সরকারি আমলাদের একচ্ছত্র আধিপত্যেও জন্য এই বাজেট নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে ফলে শতভাগ দেশীয় শিল্পগুলো রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হচ্ছে।
রোববার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
নাজমুন নাহার লাকি বলেন, আগের সরকারের আমলে বাজেটের মাধ্যমে গৃহীত সব সিদ্ধান্ত/প্রস্তাব/পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলেও শুধু সিগারেট খাতে শতভাগ দেশীয় মালিকানাধীন শিল্পের সুরক্ষার্থে এবং জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের মাধ্যমে অনুমোদিত সিদ্ধান্তটিও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দোসর তথা সিগারেট খাতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসন ও চক্রান্তের জন্য ব্যাহত হয়েছে।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ রাজস্বের সিংহভাগ আসে মূসক খাত হতে আর এই খাতে আহরিত মোট রাজস্বের এক তৃতীয়াংশ আসছে দেশের সিগারেট খাত হতে। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগানে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য নতুন নতুন খাতসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বিশেষ প্রণোদনা/কর অব্যাহতি/কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা শুধু মাত্র দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে সিগারেট খাতে আমরাও অনুরূপ ধরনের প্রণোদনা ও স্বার্থ সংরক্ষণের নীতি সহায়তা চেয়ে আসলেও বিগত সরকারের একপেশে কর-নীতির কারণে আমরা বারংবার বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছি।
তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন খাত হতে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির জন্য ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের অন্তর্বর্তীকালীন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে করনীতি ঘোষণা করা হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্ররোচনায় দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির উৎপাদিত নিম্নস্তরের সিগারেটে বৈষম্যমূলক ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আমাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছি।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে জুন মাসে নিম্নস্তরের সিগারেটে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ২ শতাংশ কর বৃদ্ধি করা হলেও উচ্চস্তরে নামমাত্র ০.৫ শতাংশ কর বৃদ্ধি করা হয়। এতে দেশীর উদ্যোক্তারা ব্যাপক বৈষম্যের স্বীকার হয়। গতকাল প্রকাশিত অন্তর্বর্তীকালীন কর অধ্যাদেশে নজিরবিহীনভাবে নিম্ন-স্লাবের সিগারেটে এক ধাপে ৫০ থেকে ৬০ টাকা মূল্য এবং ৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই দেশীয় উদ্যোক্তাদের এমন একটি রুগ্ন শিল্প খাতে দুই দফায় মোট ১৫ টাকা এবং ৯ শতাংশ কর বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা দেশের সিগারেট শিল্পের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি কোম্পানির উৎপাদিত সিগারেটে নামমাত্র ২ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করে অন্যথায় ধুঁকতে থাকা দেশীয় উদ্যোক্তাদের নিম্ন স্তরের সিগারেটে একক অর্থবছরে প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি একটি চূড়ান্ত বৈষম্য ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের শামিল। সিগারেট খাতে এই অযৌক্তিক অন্তর্বর্তীকালীন করনীতির সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি। দেশের সিগারেটের বাজার প্রায় ৫০ হজার কোটি টাকার অধিক। এ খাতে সরকারের বিগত অর্ বছরে (২০২৩- ২৪) রাজস্ব আহরিত হয় প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এ খাতের সিংহভাগ তথা ৮৫% ব্যবসা অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ ব্যবসায়িক লাভ হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রায় বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে। গত ১০ বছর আগে বিএটিবি যেখানে মাত্র ২০০ কোটি টাকা মুনফা অর্জন করত, এখন তা প্রায় ২০০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কোম্পানিটি প্রায় ৮৫ শতাংশ বিদেশি মালিকানাধীন শেয়ারের লভ্যাংশ হিসেবে প্রায় ১,৭০০ কোটি টাকা ডলারে বিনিময়ের মাধ্যমে দেশ থেকে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি জাপান টোব্যাকো জাপান সরকারের মাধ্যমে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সিগারেট খাতে অর্জিত লভ্যাংশ দেশের অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করেন না।
'অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানির লাভ দেশেই থেকে যায় এবং অন্যান্য খাতে রাজস্ব সঞ্চারী বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। আপনারা জেনে থাকবেন দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী সমূহের অনেকেই এই খাতের উদ্যোক্তা ছিলেন। কিন্তু বিগত ১০ বছরে দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের একচেটিয়া আধিপত্যে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে ব্যবসা বন্ধের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।'
সিগারেট খাতে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষা ও বাজারে সুষম বণ্টনব্যবস্থা আনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ বাস্তবায়নসহ অন্তর্বর্তী সরকারের করনীতি সংস্কারের তিন দফা দাবি জানিয়েছেন ন্যাশনাল সিগারেট।
সংগঠনের তিন দফাগুলো হলো: ১. নিম্নস্তরে দেশীয় কোম্পানির জন্য ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ঘোষিত মূল বাজেট অনুযায়ী ৬০% সম্পূরক শুল্ক বলবত রাখতে হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন অধ্যাদেশ অনুযায়ী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য ঘোষিত ৬৭% সম্পূরক শুল্ক আহরণ কঠিনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ২. ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেট নীতি কৌশল অনুযায়ী বাজারের ভারসাম্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিম্ন স্ল্যাব শুধুমাত্র দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানির জন্য সংরক্ষিত রেখে কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সুযোগ করে দিতে হবে। ৩. সিগারেট খাতে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষা ও বাজারে সুষম বণ্টন ব্যবস্থা আনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।