মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১০ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

শরণার্থী থেকে ‘নায়করাজ’

আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২২:০০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কথা। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি। কলকাতার ৮ নম্বর নাকতলা রোডের বাড়িতে জন্ম নিলেন একটি শিশু। জীবনের শুরুটাই যার কেটেছে আরেক মহাযুদ্ধের সঙ্গে লড়াই করে করে। সেই লড়াই জিতেই রাজা হয়েছিলেন। তিনি চিত্রনায়ক রাজ্জাক। ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন রাজ্জাক। এসেছিলেন শরণার্থী হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে ‘নায়করাজ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। 

নায়করাজ রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত

একজীবনে রাজ্জাক সিনেমা ছাড়া অন্য কিছুই স্থায়ীভাবে করেননি। যতক্ষণ শক্তি ছিল, পুরোদমে ক্যামেরার সামনে-পেছনে কাজ করে গেছেন। চার দশকে তিনি নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আজ তার জন্মদিন, বেঁচে থাকলে আজ ৮৩ বছর পূর্ণ করতেন নায়করাজ রাজ্জাক।

রাজ্জাকের প্রথম নায়িকা সুচন্দা। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

সিনেমার নায়ক হওয়ার অদম্য স্বপ্ন ও ইচ্ছা থাকায় কলকাতার থিয়েটারে অভিনয় করার মাধ্যমে রাজ্জাক তার অভিনয়জীবন শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে সিনেমার ওপর পড়াশোনা ও ডিপ্লোমা করেন।

‘বেহুলা’ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল রাজ্জাকের জীবনের। ছবি: সংগৃহীত
 
এরপর কলকাতায় ফিরে এসে ‘শিলালিপি’ ও আরও একটি সিনেমায় অভিনয় করেন। তবে ১৯৬৪ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে পড়ে রাজ্জাক তার পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে রাজ্জাক ‘উজালা’ সিনেমায় পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

‘নীল আকাশের নিচে’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে রাজ্জাক আবির্ভূত হলেন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে। ছবি: সংগৃহীত
 
ষাটের দশকে সালাউদ্দিন পরিচালিত হাসির সিনেমা ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ এ একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে রাজ্জাক ঢাকায় তার অভিনয় জীবনের সূচনা করেন। যদিও এর আগেই চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল এই অভিনেতার।

‘চিত্রালী’ পত্রিকার সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী রাজ্জাককে ‘নায়করাজ’ উপাধি দিয়েছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
 
নায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে নায়ক রাজের যাত্রা শুরু হয় বিখ্যাত পরিচালক জহির রায়হানের হাত ধরে। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ সিনেমায় সুচন্দার বিপরীতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করে ঢালিউডে নায়ক হিসেবে অভিষেক হয় রাজ্জাকের। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। দর্শক হৃদয়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে সিনেমাটি।

সপরিবারে নায়করাজ রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত
 
১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়েই তিনি অর্জন করেন ‘নায়ক রাজ’ রাজ্জাক খেতাব। অর্জন করেন একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা। এ ছাড়া রাজ্জাক জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও কাজ করছেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের সফল জুটি রাজ্জাক-শাবানা। ছবি: সংগৃহীত
 
রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘মধু মিলন’, ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘কী যে করি’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অশিক্ষিত’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাদী থেকে বেগম’ ইত্যাদি। প্রায় ৩০০ সিনেমায় নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন তিনি।

‘অনন্ত প্রেম’ ছবিতে রাজ্জাক-ববিতা জুটির কথাও মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে। ছবি: সংগৃহীত
 
সিনেমা প্রযোজনাও করেছেন চিত্রনায়ক রাজ্জাক। প্রযোজক হিসেবে নায়ক রাজের যাত্রা শুরু ‘রংবাজ’ ছবিটি প্রযোজনার মধ্য দিয়ে। এটি পরিচালনা করেছিলেন জহিরুল হক। ওই সিনেমায় রাজ্জাকের বিপরীতে ছিলেন কবরী।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ সেলুলয়েডের ফিতায় এনে দর্শকের অশ্রু ঝরিয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। ছবি: সংগৃহীত
 
ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে নায়করাজ প্রথম নির্দেশনায় আসেন ‘অনন্ত প্রেম’ চলচ্চিত্র দিয়ে। এই ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আজও মাইলফলক হয়ে আছে। নায়ক হিসেবে এ অভিনেতার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল শফিকুর রহমান পরিচালিত ‘মালামতি’। এতে তার বিপরীতে ছিলেন নূতন।

রাজ্জাক শুধু নায়ক হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও বেশ সফল। ‘আয়না কাহিনী’সহ কয়েকটি ছবিটি নির্মাণ করেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত
 
রাজ্জাক সর্বশেষ তার বড় ছেলে নায়ক বাপ্পারাজের নির্দেশনায় ‘কার্তুজ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামও অভিনয় করেছিলেন। চাষী নজরুল ইসলামের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমায়ও রাজ্জাক অভিনয় করে প্রশংসিত হন।

১৯৬৮ সালে রাজ্জাক-সুচন্দা জুটির মেয়ে হিসেবে ‘সংসার’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা। সেটি ছিল জহির রায়হানের ছবি। তারই পরিচালনায় ১৯৭০ সালে ‘টাকা আনা পাই’ ছবিতে ববিতা রাজ্জাকের নায়িকা হন। ছবি: সংগৃহীত
 
২০১৭ সালের ২১ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমান নায়করাজ খ্যাত এ অভিনেতা। নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত তাকে নেয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক অভিনেতাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাজধানীর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সত্তর দশকের কিংবদন্তি এ অভিনেতা।

ইত্তেফাক/এসএ
 
unib