বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ “ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টাসে' বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে। সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরের (২০২৪ - ২০২৫ ) বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অন্তত পাঁচটি কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চরম আবহাওয়ার (বন্যা ও তাপপ্রবাহ) প্রভাব মোকাবিলা, দূষণ (বায়ু, মাটি ও পানি), বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব অন্যতম। এই চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারলেই দেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু যেভাবে দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে, তাতে প্রত্যাশিত মাত্রায় সফলতা অর্জনের কোনো আলামত এখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
বিশ্বব্যাংক আরো বলেছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিশীলতার কারণে ভবিষ্যতে দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পেতে পারে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে উদ্যোক্তাগণ নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো' নীতি অনুসরণ করছেন। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মোতাবেক, দেশের ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। কয়েক বছর আগে একপর্যায়ে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থবিরতা নেমে আসতে বাধ্য। চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। দায়িত্ব নিয়েই বলা যেতে পারে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার ন্যূনতম কোনো সম্ভাবনা নেই।
যে কোনো দেশের জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় বৃদ্ধি না পেলে প্রোডাক্টিভ সেক্টরের বিকাশ ঘটবে না। আর সেই অবস্থায় কর্মসংস্থানের হার কমে যেতে পারে—যা চূড়ান্ত পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচন- প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দেশে ব্যবসায়রত শিডিউল ব্যাংকগুলোর একটি বড় অংশই বিনিয়োগযোগ্য তহবিলসংকটে ভুগছে; অর্থাৎ তারা চাইলেও বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি টাকা ছেপে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে তহবিল জোগান দেয়, তাহলে সেটা উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিতে পারে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শিডিউল ব্যাংকগুলোকে তাদের বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে জমা রাখতে হয়। জমা রাখা এই অর্থকে ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট বা সিআরআর বলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সিআরআর জমার হার হ্রাস করে, তাহলে শিডিউল ব্যাংকগুলোর তারল্যপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এই অবস্থায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে ঢালাওভাবে কম ব্যাংকের সিআরআর হার না কমিয়ে বরং দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সিআরআর রেট কমানো যেতে পারে। কিন্তু সিআরআর রেট কমিয়ে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তার পরিমাণ খুব একটা বেশি হবে না। কাজেই এই উদ্যোগ ব্যাংকের তারল্যসংকট মেটানোর জন্য খুব একটা কার্যকর বলে প্রতীয়মান হবে না।
চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এটা কোনোভাবেই অর্জনযোগ্য নয়। অবশ্য বর্তমান অবস্থায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে অন্যান্য দিকে, বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করাই হবে সবচেয়ে যৌক্তিক। কারণ সব শ্রেণিপেশার মানুষ, বিশেষ করে, নির্দিষ্ট আয়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে খুবই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। গত বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৫ শতাংশ। একই সময়ে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় দশমিক ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দশমিক ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। যেহেতু চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির মোটেও কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসবে।
তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বাস্তবতার প্রেক্ষিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক বেশি পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণকে কঠিন করতে চাইছে। এর অর্থ হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পেলে সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ কমে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার কিছু দিন আগ পর্যন্তও ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে রেখে ছিল। এতে উলটো ফলে হয়েছে। বাজারে অর্থ জোগান বেড়ে গেছে। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির তুলনায় ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল কম। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদের হার দীর্ঘ দিন ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে রাখার ফলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করার ফলে অনেকটা হঠাৎ করেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫/১৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এতে উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদনরত শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা পলাতক রয়েছেন অথবা গ্রেফতারবরণ করেছেন। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। স্বাভাবিক ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না। ফলে ভবিষ্যতে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বিপন্ন হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের যদিও গভর্নর বলেছেন, এ বছরের মধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। কিন্তু তার এই আশ্বাসবাণীতে পুরোপুরি আস্থা রাখা যাচ্ছে না। কারণ বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে ভিন্ন কথা বলেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভবিষ্যতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিপ্রবণতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজমান থাকবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি পঞ্জিকা বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থাকবে। অন্যদিকে একই সময়ে ভারতের মূল্যস্ফীতির ৫ দশমিক ২২ শতাংশ, পাকিস্তানের ৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার নেগেটিভ ১ দশমিক ৭ শতাংশ থাকবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না, যদি সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিতে মজুরি বৃদ্ধের হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি থাকে, যেমন— কোনো দেশের মূল্যস্ফীতির হার যদি ১০ শতাংশ হয় এবং মজুরি বৃদ্ধির হার যদি ১৫ শতাংশ হয়, তাহলে সেই দেশের মানুষকে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটেছে উলটো। গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মজুরির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম গতিতে। ২০০২ সালে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। একই সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। কিন্তু এর পর থেকে এ পর্যন্ত আর কখনোই মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতিকে অতিক্রম করতে পারেনি। এ বছর জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এটা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব। বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার আরো অনেক বেশি এবং মজুরি বৃদ্ধির হার আরো কম বলে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন।
বিগত সরকারের সময় থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতিপ্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি পলিসি রেট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করে দিত, তাহলে পরিস্থিতি এতটা জটিল হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকত না। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা দূরীকরণে সক্ষম হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক