বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘সংস্কার' একটি বহুল আলোচিত বিষয়। ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে বিরাজমান গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং স্থায়ী উন্নয়নের পথ তৈরি করতে দ্রুত গতিতে ১১টি খাতের জন্য সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই কমিশনগুলোর রিপোর্ট জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে; এরই মধ্যে চারটি কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাকিগুলোর প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাওয়া যাবে। সংস্কারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
তবে অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয় হলো, সংস্কারের জন্য বিবেচিত খাতগুলোর তালিকায় সব সংস্কারের সূতিকাগার তথা শিক্ষা খাতের মতো মৌলিক একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, অন্যান্য খাতের সংস্কারের কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব কতটা বাস্তবায়নযোগ্য হবে?
শিক্ষা কেবল একটি খাত নয়, বরং এটি এমন একটি ভিত্তি, যার ওপর অন্যান্য সব খাতের সংস্কার-সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে। ফলে শিক্ষা খাতের ওপর পর্যাপ্ত গুরুত্ব আরোপ ছাড়া অন্যান্য খাতে অর্থবহ অগ্রগতি অর্জন প্রায় অসম্ভব। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা সর্বজনীনভাবে জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘ সময় ধরেই নানবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এ খাতের সমস্যাগুলো কেবল ব্যক্তিগত উন্নয়নেই বাধা সৃষ্টি করে না, বরং এটি স্বাস্থ্য, শাসনব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জাতীয় উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়ার মূল চাবিকাঠি।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা প্রায়শই মুখস্থ শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়, যা শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যার সমাধানের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির চাহিদার সঙ্গে বর্তমান পাঠ্যক্রমের অসামঞ্জস্যের ফলে শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব অনুভব করছে, যা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাছাড়া যদিও সামগ্রিক ভর্তিহার বৃদ্ধি পেয়েছে, গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে এখনো উল্লেখযোগ্য বৈষম্য বিদ্যমান।
বিশেষত গ্রামীণ এলাকাগুলোতে, যেখানে শহুরে কেন্দ্রগুলোর তুলনায় অবকাঠামো, শিক্ষার উপকরণ এবং দক্ষ শিক্ষকের অভাব প্রকট। একই সঙ্গে, আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা; যেমন— দারিদ্র্য, নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক প্রথা, অনেক শিশুকে, বিশেষ করে মেয়েদের, প্রাথমিক স্তরের পর শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে।
শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মতো বিষয়গুলো শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকরা প্রায়ই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি অন্যতম প্রধান বাধা। এছাড়া, শিক্ষকদের তুলনামূলকভাবে কম বেতন, অপ্রতুল সুযোগ- সুবিধা এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ তাদের পেশাগত অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এর ফলে উচ্চমাত্রায় পদত্যাগ, চাকরি পরিবর্তন এবং শিক্ষার মান হ্রাস পাচ্ছে।
পাশাপাশি দেশের অনেক স্কুল অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই পরিচালিত হয়। এসব স্কুলে অতিরিক্ত ছাত্রসংখ্যার চাপ, পর্যাপ্ত পাঠদানসামগ্রীর অভাব এবং মৌলিক সুযোগ- সুবিধা, যেমন–পরিষ্কার পানি ও বিদ্যুতের ঘাটতি প্রকট। এ পরিস্থিতি শিক্ষার জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ। গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার মধ্যে প্রযুক্তিগত সুবিধার বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। শহুরে স্কুলগুলোতে ইন্টারনেট, কম্পিউটার ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য হলেও গ্রামীণ স্কুলগুলোতে এসব সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত। প্রযুক্তির অভাব শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন বাধাগ্রস্ত করে, যা তাদের আধুনিক কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয়। গ্রাম-শহর বিভাজন দূর করে সমান প্রযুক্তিগত সুযোগ নিশ্চিত করা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বস্তুত, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষা খাতের সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ অন্যান্য খাতের সাফল্য সরাসরি শিক্ষার মান ও প্রসারের ওপর নির্ভরশীল। গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অপরিসীম। মানসম্মত শিক্ষাসচেতন নাগরিক তৈরি করে, যারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং নেতাদের জবাবদিহির আওতায় রাখতে সক্ষম।
পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে শিক্ষার অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষা সরাসরি একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মশক্তি তৈরির জন্য মানসম্মত শিক্ষা অত্যাবশ্যক। শিল্পায়ন ও প্রযুক্তি খাতে অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে আইসিটি, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য। উপরন্তু, শিক্ষার উন্নতি স্বাস্থ্য খাতেও আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।
পরিবেশ সংরক্ষণেও শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির জন্য শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা জনগণকে বন উজাড়, নদীদূষণ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করে। এটি টেকসই পরিবেশ সংরক্ষণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে।
এমতাবস্থায় শিক্ষা খাতের উন্নতির জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রণয়নের বিশেষ প্রয়োজন। প্রথাগত মুখস্থ শিক্ষার পরিবর্তে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা এবং বাস্তব দক্ষতা শেখানোর জন্য পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলছেন অনেকে। আর সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ এবং কর্মক্ষেত্রের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পাঠ্যক্রম তৈরির বিষয়ে নজর দিতে হবে।
বৈষম্য দূর করতে হবে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলোর জন্য বিশেষ বৃত্তি এবং সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। নারী শিক্ষার প্রসারে গ্রহণ করতে হবে আলাদা পরিকল্পনা। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি মানসম্পন্ন শিক্ষকতাকে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির একীভূতকরণও অত্যন্ত জরুরি। অনলাইন শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল শিক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল টুলস এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান স্কুলগুলোর অবকাঠামো উন্নত করতে হবে। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, পাঠদানসামগ্রী, নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির প্রভাব এবং দুর্নীতিমুক্ত রাখাটাও অপরিহার্য। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্মূল করা না গেলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন অসম্ভব।
চলমান প্রেক্ষাপটে অবিলম্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। যথোচিত পন্থায় পরিচালিত হলে এই কমিশন শুধু শিক্ষা খাতের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনই আনবে না, বরং অন্যান্য খাতের জন্য গৃহীত সুপারিশ বাস্তবায়নেও তা সহায়ক হবে। এভাবে সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণা, এবং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষা খাতের আধুনিকায়ন করলে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। বর্তমান সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এই বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষা খাতের সংস্কারই দেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়