শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

মহাখরা: এক আসন্ন বিপর্যয়ের বার্তা

আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:০০

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি করিতেছে। তন্মধ্যে ‘মহাখরা' নামক এক গভীরতর বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করিয়াছেন। যদিও মহাখরার কোনো সর্বসম্মত সংজ্ঞা এখনো নির্ধারিত হয় নাই, তথাপি ইহার তাৎপর্য সুস্পষ্ট। মহাখরার ধারণাটি প্রথম কনি উডহাউস এবং জোনাথন ওভারপেক ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে উত্থাপন করেন। তাহারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুইটি দীর্ঘস্থায়ী এবং তীব্র খরার বিবরণ দিয়াছেন, যাহা স্থানীয় জনজীবন ও পরিবেশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করিয়াছিল। বর্তমানে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ বিশ্ব জুড়ে মহাখরার পুনরাবৃত্তি হইবার আশঙ্কা তীব্রতর হইয়াছে।

মহাখরা যে নূতন কিছু নহে, তাহার প্রমাণ ইতিহাসে বিদ্যমান। ১২৭৬ হইতে ১২৯৯ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় এক দীর্ঘস্থায়ী মহাখরা দেখা গিয়াছিল, যাহা 'দ্য গ্রেট ড্রট' নামে পরিচিত। ইহার কারণে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী যেমন আনাসাজি ও হোহোকামদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি বিপর্যস্ত হইয়া পড়ে। বারংবার ফসলহানির ফলে তাহারা বসতি ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। তদুপরি, খাদ্যের অভাব ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে অঞ্চলের সামগ্রিক পরিবেশ বিপন্ন হইয়া উঠে। এই মহাখরা প্রমাণ করে, দীর্ঘস্থায়ী খরা মানবসভ্যতার ওপর কত গভীর প্রভাব ফেলিতে পারে।

সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ায় উদ্ভূত দাবানল ইহার একটি বাস্তব উদাহরণ। গবেষকগণ উল্লেখ করিয়াছেন, এই দাবানলের প্রধান কারণ ছিল, ব্যতিক্রমী খরা। তাহারা আরো বলিয়াছেন, ভবিষ্যতে এমন আরো অগণিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটিতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং ভূমির আর্দ্রতা হ্রাস পাইতেছে। গত তিন দশকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খরার চিহ্ন স্পষ্ট হইয়াছে। গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গিয়াছে, ইহার নেতিবাচক প্রভাব আগামী এক দশক ধরিয়া সক্রিয় থাকিবে। মহাখরার কারণে সুপেয় পানির সংকট তীব্রতর হইবে এবং খাদ্যনিরাপত্তা বিপন্ন হইবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাখরার পাশাপাশি মহাদাবানলেরও সৃষ্টি হইবে। ইহা কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাইবে। ফলত, খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস পাইয়া কোটি কোটি মানুষের জীবন অনাহার ও দারিদ্র্যের সম্মুখীন হইবে। পরিবেশের ওপর এই প্রতিক্রিয়াগুলো দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমাত্রিক হইবে।

সুইজারল্যান্ডের সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট ফর ফরেস্ট, স্নো অ্যান্ড ল্যান্ডস্কেপ রিসার্চের গবেষণাপত্রে লিয়ানজি চেন নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখানো হইয়াছে, মহাখরার কারণগুলি সম্পূর্ণরূপে মানবসৃষ্ট। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন, অরণ্যনিধন এবং অবৈজ্ঞানিক কৃষিকাজ ইহার মূল কারণ। যদি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহা হইলে পৃথিবী এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হইতেছে। তাহা হইলে, এই সংকট সমাধানের উপায় কী? প্রথমত, বৈশ্বিক জলবায়ু নীতিমালা আরো কার্যকর করিতে হইবে।

কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার, এবং টেকসই কৃষিকাজ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করিয়া একযোগে এই সংকট মোকাবিলা করিতে হইবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করিতে হইবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় টিকসই অভ্যাস গড়িয়া তুলিতে হইবে। উদাহরণস্বরূপ, পানির অপচয় রোধ, বনাঞ্চল সংরক্ষণ, এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করিতে হইবে। চতুর্থত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নকে কাজে লাগাইয়া কৃষিক্ষেত্রে খরা সহিষ্ণু ফসলের উৎপাদন বাড়াইতে হইবে। গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রতিকূলতার মোকাবিলায় সক্ষম হইবার জন্য উদ্ভাবনী পন্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

মহাখরা একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং ইহার সমাধানও বৈশ্বিক স্তরে খুঁজিতে হইবে। ইহার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা এবং সকল স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। জলবায়ুর এই সংকটময় অবস্থায় যদি আমরা অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তাহা হইলে পৃথিবী একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হইবে। তাই, মানবজাতিকে এখনই ইহা উপলব্ধি করিয়া সক্রিয় হইতে হইবে। তাহা হইলেই কেবল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করা সম্ভব হইবে।

ইত্তেফাক/এনএন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib