রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

ট্রাম্প ২.০: ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে কি শান্তি ফিরবে?

আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:৫৯

চলতি মাসের ২০ তারিখে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার নির্বাচনি প্রচারণার সময় তিনি বারবার বলেছিলেন, 'যেদিন ক্ষমতায় ফিরে আসব, সেদিন থেকেই যুদ্ধ বন্ধের কাজ শুরু হয়ে যাবে। যদিও এখনো বলা যাচ্ছে না, তিনি কবে নাগাদ এবং ঠিক কীভাবে সম্পূর্ণর পে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ইতি টানবেন, তবে এটা স্পষ্ট যে, তিনি তার প্রথম মেয়াদের তুলনায় এবার অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। এবারের নির্বাচনে তার দল কংগ্রেসের দুই কক্ষ 'হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস' ও ‘সিনেটে’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এর ফলে আগামী দুই বছর পুরো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কার্যক্রম তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

বিশ্বের অধিকাংশ রাজনৈতিক সচেতন মানুষ হয়তো ভাবছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে কীভাবে যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলো সমাধান করবেন। বিশেষ করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধগুলোর ক্ষেত্রে তার নীতি কীভাবে কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার মধ্যে একটি বড় সিদ্ধান্ত হতে পারে জাতিসংঘ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও জি-৭-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা। তিনি জি-২০ এবং ব্রিকস (BRICS)-এর মতো বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্ল্যাটফরমের প্রতি বেশি মনোযোগ দেবেন।

ইতিমধ্যেই তিনি একটি কড়া বার্তা দিয়েছেন, যদি ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বদলে তাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তাহলে তিনি সেই দেশগুলোর পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। এই কঠোর বার্তা ইঙ্গিত দেয়, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প চীনের পক্ষে কোনো সুযোগ তৈরি হতে দেবেন না। তার নির্বাচনি প্রচারণার সময় তিনি তাইওয়ানকে অভিযুক্ত করেছিলেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের চিপ প্রযুক্তি নকল করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি তাইওয়ানের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দেন।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি শক্তি দেখিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথ খুঁজতে আগ্রহী ছিলেন। তবে এবার মনে হচ্ছে, তিনি ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করবেন। এবার তার কৌশল হবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। তিনি সরাসরি ‘বৈশ্বিক পুলিশ' হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে নিজের দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করবেন।

ট্রাম্পের মনোযোগ মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার দিকে থাকবে। এই লক্ষ্যে তিনি মার্কো রুবিয়ো ও মাইক ওয়াল্টজকে তার পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছেন। তারা দুজনই চীনের ব্যাপারে কঠোর মনোভাবাপন্ন। এর অর্থ হলো, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্য ট্রাম্পের প্রশাসনের অগ্রাধিকারের তালিকার শীর্ষে থাকবে না। চীনের প্রতি মনোযোগ দিতে এবং নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার পথ বেছে নেবেন। এজন্যই ট্রাম্প বলেছেন, তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক দিনের মধ্যে ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করবেন।'

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি শক্তি দেখিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার পথ খুঁজতে আগ্রহী ছিলেন। তবে এবার মনে হচ্ছে, তিনি ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করবেন। এবার তার কৌশল হবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। তিনি সরাসরি ‘বৈশ্বিক পুলিশ’ হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে নিজের দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করবেন
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক পরিচালনা করেছিলেন। তবে বৈশ্বিক রাজনীতি আর আগের মতো নেই। গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। চীন, রাশিয়া ও ইরানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র সামান্য হলেও কিছুটা কূটনৈতিক শক্তি হারিয়েছে। ট্রাম্প এখন এই দুর্বলতাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন।

তাই এবার তিনি যুদ্ধ এড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেবেন। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি এই প্রচেষ্টার কেন্দ্রে থাকবে। এই নীতির আওতায় তিনি দেশের সীমান্ত সুরক্ষা, জ্বালানি নিরাপত্তা, বিরল খনিজ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দেবেন।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে একটি বড় বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত হবে তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো। তুরস্ক এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যা বর্তমানে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগর বর্তমানে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলোতে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। তুরস্ক এই অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং এর উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্তে এই মুহূর্তে সংঘর্ষ চলছে। এই অস্থিরতা তুরস্ককে তার চারপাশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য তৎপর হতে বাধ্য করেছে। একই সঙ্গে, এমন পরিস্থিতি তুরস্ককে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকটে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিয়েছে।

অন্যদিকে, ইউরোপে শক্তির ভারসাম্য মূলত তিনটি পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে— ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), রাশিয়া ও তুরস্ক। এই তিন পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাদের প্রত্যেকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে কেউই অন্য দুই পক্ষের সহায়তা ছাড়া এককভাবে শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম নয়। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তাদের একদিকে শক্তিশালী করেছে, আবার অন্যদিকে দুর্বলও করেছে। অন্যভাবে বললে, এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই পশ্চিম ইউরেশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য তৈরি করে।

শুধু বাণিজ্য নয়, জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর নির্ভরশীলতাও এই শক্তির ভারসাম্যের অন্যতম প্রধান কারণ। ইউক্রেন যখন রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর কাছে সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন এটি রাশিয়ার জন্য একটি বিশাল বাজার হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি সদস্য দেশের জ্বালানি সরবরাহে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতার দুর্বলতাগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। ইউক্রেনের এই পদক্ষেপের পর যে দেশগুলো জ্বালানির ঘাটতিতে ভুগছে, তাদের জন্য 'টার্কস্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন' বিকল্প পথ হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের এই শক্তির ভারসাম্য ভালোভাবেই বোঝেন। এই অঞ্চলে তুরস্ক শক্তিশালী একটা স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ট্রাম্প উভয়েই একসঙ্গে কাজ করার পদ্ধতি জানেন এবং দক্ষতার সঙ্গে তা করতে পারেন। এই কারণেই আমরা দেখতে পাই, ট্রাম্প সম্প্রতি সিরিয়ার ঘটনাপ্রবাহের জন্য এরদোয়ান ও তুরস্কের প্রশংসা করেছেন।

একটি বিবৃতিতে ট্রাম্প সরাসরি বলেছেন, “এরদোয়ান বুদ্ধিমান এবং সিরিয়ার ঘটনাপ্রবাহে তিনি যোগ্যতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।' তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো উচিত নয়।' তার মতে, সিরিয়ার জনগণ এবং তাদের প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোকে তাদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়াই।

ট্রাম্প ভালোভাবেই জানেন, ইসরাইল- ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধানের জন্য তুরস্ককে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে। এই কারণে তুরস্ক ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবে। তবে এটা স্পষ্ট যে, এবারের ট্রাম্প প্রশাসন তার দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে চীনের ওপর নিবদ্ধ রাখবে। যার ফলে, ট্রাম্প ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যকে তার অগ্রাধিকারের তালিকায় নিচের দিকে রাখবেন। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য, যেমন পানামা ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ে তার বক্তব্য, এই ধারণারই ইঙ্গিত দেয়।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তন বিশ্ব জুড়ে সংঘাতের সংখ্যা কমিয়ে আনবে কি না? এর উত্তর শুধু সময়ই দিতে পারবে। তবে, যদি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ পর্যালোচনা করা হয়, একটি বিষয় নিশ্চিত, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি নতুন আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যভাবে বললে, বেইজিংকে ট্রাম্পের আরেকটি মেয়াদের মুখোমুখি হতে হবে। ট্রাম্প সম্ভবত তার আগের ‘চীনের সঙ্গে আলোচনা' নীতি আবার চালু করবেন। যদি এর সরাসরি ফলাফল না-ও পাওয়া যায়, তবুও এই নীতি বিশ্বকে আশার একটি আলো দেখাতে পারে যে, অন্তত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা হয়তো এড়ানো সম্ভব।

লেখক : ‘জনস হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ'-এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা 
ডেইলি সাবাহ থেকে অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন

ইত্তেফাক/এনএন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib