কামরাঙ্গীরচরে ইতি জুয়েলার্সের মালিক সজল রাজবংশী। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে সেকশন বেড়িবাঁধ এলাকায় পৌঁছালে একাধিক মোটরসাইকেলে সাত-আট জন এসে সজলের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে এবং তার বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলি করে। পরে তারা সজলের কাঁধে থাকা স্বর্ণের ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আহত সজলের দাবি, তার ব্যাগে ৫০ ভরি স্বর্ণালংকার ও সাড়ে ৩ লাখ টাকা ছিল।
কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি আমীরুল ইসলাম বলেন, ঐ ঘটনায় ভিকটিমের ভাই অজয় রাজবংশী বাদী হয়ে একটি ডাকাতির মামলা করেছেন। ভিকটিমের দোকানে তিন জন কর্মচারী ছিল। আমরা ঘটনাস্থলের আশপাশে থেকে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করে পর্যবেক্ষণ করছি।
বর্ধিত নজরদারি এবং বিশেষ অভিযানের মধ্যেও রাজধানীর সড়কে রাতের বেলায় বেড়েছে ছিনতাইকারী আতঙ্ক। সাম্প্রতিক অপরাধের পরিসংখ্যান থেকে বলা হচ্ছে যে, ছিনতাইয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, সবুজবাগ, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, রামপুরা ও বাড্ডা থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে।
পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে বা যখন কেউ হাতেনাতে ধরা পড়ে তখন তারা দ্রুত বিচার আইনে ঐ ঘটনা রেকর্ড করে। তবে পাঁচ জনের কম লোক ছিনতাই বা ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকলে তখন পেনাল কোডের অধীনে মামলা হয়। এসব মামলাকে পুলিশ ‘ডাকাতি’ (দস্যুতা) মামলা বলে থাকে। কামরাঙ্গীরচরে স্বর্ণালংকার ছিনতাইয়ের ঘটনায় ডাকাতির মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ক্রাইম ডেটাবেসে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে সারা দেশে মোট ১৫৯টি ‘ডাকাতি’ মামলা করা হয়েছিল, যা নভেম্বরে ছিল ১৩৩টি।
২০২৪ সালে এই মামলার সংখ্যা আগের বছরের ১ হাজার ২২৭টি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪১২টিতে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, ছিনতাইয়ের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে, কারণ অনেকেই এসব ঘটনায় মামলা করেন না, আবার অনেকে আইনি ঝামেলা এড়াতে ছিনতাইয়ের ঘটনাকে জিনিসপত্র হারানো গিয়েছে উল্লেখ করে সাধারণ ডায়ারি করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ শাখার এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে রাজধানীতে ৪৩২টি ছিনতাইয়ের জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই স্থানগুলোতে কমপক্ষে ৯৭৯ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে এবং তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন থানায় দায়ের করা ফৌজদারি মামলার আসামি। ডিএমপির মতিঝিল ও ওয়ারি বিভাগে কমপক্ষে ২১২ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে। মিরপুর ও তেজগাঁও বিভাগে প্রায় ৩৮৬ জন, রমনা ও লালবাগ বিভাগে ২১৭ জন এবং উত্তরা ও গুলশানে ১৫৪ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে।
তালিকায় উঠে এসেছে মোহাম্মদপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এই এলাকায় ২০৫ জন ছিনতাইয়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি ১০৮টি ছিনতাইয়ের স্পট রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা, মিরপুর, শাহআলী, আবদুল্লাহপুর এবং বিমানবন্দর এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ব্যস্ততম সড়কে প্রতি রাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। কখনো কখনো প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাইকারীরা ব্যক্তিগত গাড়ি এবং বাসের যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন বা স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়।
৫ আগস্টে পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, অভিযান চলাকালীন ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত ৮৬৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ৯১ জন, নভেম্বরে ১৪৮ জন এবং ডিসেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ৫৬৪ জন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ পর্যালোচনা সভায় কমিশনার এস এম সাজ্জাত আলী বলেন, ছিনতাইকারী এবং চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে জোর দেওয়ার নির্দেশ দেন।
গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে গুলশান ২ নম্বর ডিএনসিসি মার্কেটের সামনে সিটি মানি এক্সচেঞ্জের কর্ণধার কাদের শিকদার (৩৫) ও তার শ্যালক আমির হামজাকে (২৫) কুপিয়ে ইউএস ডলার, ইউরো ও নগদ টাকাসহ প্রায় দেড় কোটি টাকা ছিনতাই হয়। একই দিন রাতে বাড্ডার মেরুল বাড্ডা এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন মোহাম্মদ টিপু মিয়া (২২) নামে এক চালক। এ সময় ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে নিয়ে গেছে একটি মোবাইল ফোন ও ৩০ হাজার টাকা।
গত ১৫ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে ইসলামপুরের একটি পোশাকের দোকানের কর্মচারী ১৮ বছর বয়সি মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে মগবাজারে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
পুলিশ সূত্র জানায়, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মানিকনগর, সবুজবাগ, মুগদা এবং মীরহাজীরবাগকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ছিনতাই এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে মাদকাসক্ত ছিনতাইকারীরা প্রায়শই মোবাইল ফোনের জন্য মানুষজনকে টার্গেট করে। গত ১৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সায়েদাবাদে কাপড় ব্যবসায়ী কামরুল হাসানকে (২৩) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ডিএমপি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। ছিনতাই প্রতিরোধে রাত্রীকালীন পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়েছে। লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারও হয়েছে। ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।