পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করিয়াছেন, 'প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে।' অর্থাৎ, মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। ইহা অনিবার্য ও অবধারিত নিয়তি। মূলত এই কারণেই আমরা অবচেতন মনে হইলেও 'কেমন মৃত্যু চাই'-এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে চেষ্টা করি! অস্কার ওয়াইল্ড যেমনটি বলিয়াছেন, 'মৃত্যু খুব সুন্দর হইতে হইবে। নরম বাদামি মাটিতে শুইয়া থাকা, ঘাসের সঙ্গে মাথার দোল খাওয়া, পিনপতন নীরবতা, গতকাল নাই, আগামীকাল নাই...।'
সত্যি বলিতে, এই ধরনের মৃত্যু কে না চাহিবে? কিন্তু তাহা কি সকলের ভাগ্যে জুটে? অনেকে ভাবতে পারেন যে-বর্ষাকালে এইখানে, শীত-গ্রীষ্মে ঐখানে বসবাস করিব। এইভাবে নানা শিডিউলের মধ্য দিয়া আমরা জীবনকে সাজাইয়া তুলিতে চেষ্টা চালাই। যদিও আমরা কখনোই জানি না যে, বর্ষা, শীত বা গ্রীষ্ম মৌসুম কোন জায়গায়, কীভাবে কাটিবে। অর্থাৎ, জীবন-মৃত্যুর এই ধরাবাঁধা ছকের বাহিরে গিয়া আমাদের চিন্তা করিবার সামর্থ্য নাই একদমই। তবে ইহার পরও কথা থাকিয়া যায়! কারণ, কিছু কিছু মৃত্যু মানুষকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলে। 'স্বাভাবিক' মৃত্যুতে কাহারও হাত না থাকিতে পারে, কিন্তু 'অস্বাভাবিক' মৃত্যু লইয়া আমরা। । কী বলিব? কাছের মানুষের চিরবিদায় যেই শূন্যতা সৃষ্টি করে, তাহার ভার স্বাভাবিকভাবে বহন করিবার শক্তি কি সকলের মধ্যে থাকে?
বিভিন্ন সময় আমরা যেই সকল অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটিতে দেখি-হউক তাহা সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা যুদ্ধবিগ্রহে প্রাণহানি, সেই সকল ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের উপর দিয়া কী ঝড় বহিয়া যায়, তাহা কেবল ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করিতে পারিবেন। গত বুধবার (২৯ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে মধ্য আকাশে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ও সামরিক হেলিকপটারের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় যেই তরতাজা প্রাণগুলি ঝরিয়া গেল, তাহাদের পরিবার-স্বজনদের মানসিক অবস্থা এখন কোন অবস্থায়? এই দুর্ঘটনা তাহারা কীভাবে মানিয়া লইবে, এই ক্ষয়ক্ষতি তাহারা কীভাবে পোষাইবে? বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজটিতে ৬০ জন যাত্রী ও চার জন এজন ক্রু এবং হেলিকপটারটিতে তিন সৈন্য ছিলেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হিমশীতল পটোম্যাক নদী হইতে ৩০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা গিয়াছে। আমরা এই দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য শোকাহত এবং ভুক্তভোগী পরিবারগুলির প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।
এই ধরনের দুর্ঘটনা এবং তাহাতে অস্বাভাবিক মৃত্যুর চিত্র নূতন কিছু নহে। বরং বলিতে হয়, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া বাড়িতেছে এহেন ঘটনা-দুর্ঘটনা। গত মঙ্গলবার উত্তর ভারতে হিন্দুদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব কুম্ভ মেলায় পদদলিত হইয়া অন্তত ৩০ জনের মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানলের ক্ষয়ক্ষতির কথাও আমরা স্মরণ করিতে পারি। এই ধরনের বহু উদাহরণ রহিয়াছে। প্রশ্ন হইল, এই ধরনের ঘটনাগুলির রেশ কি কেবল হতাহত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে? অবশ্যই নহে। কারণ, জন্মগ্রহণ করিবার পর সাধারণত প্রতিটি মানুষ একটু একটু করিয়া পরিপূর্ণতা লাভ করেন এবং একটি সময়ে আসিয়া তিনি স্বাবলম্বী হইয়া উঠিলে তাহার উপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়। প্রায় প্রতিটি পরিবারই পরিচালিত হইয়া থাকে এইরূপভাবে। শুধু পরিবার কেন, তাহার উপর বিভিন্ন প্রয়োজনহেতু নির্ভর করিয়া থাকে সমাজ, দেশ এবং সর্বোপরি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। অর্থাৎ, সেই ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু তাহার পরিবার তো বটেই, অনেকের জন্যই বহু প্রতিকূল-প্রতিবন্ধকতা বহিয়া আনে। বিশেষত, 'দায়িত্ব' বড় কঠিন জিনিস-ইহা যাহাদের উপর রহিয়াছে, সেই মানুষগুলির অকস্মাৎ ও অপমৃত্যু মানিয়া লওয়া যে কারো জন্যই কঠিন। মানসিক দিক তো বটেই, অর্থনৈতিক বিষয়টিও এইখানে মুখ্য। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারাইয়া পরিবারগুলি এক নিমেষে পথে বসিয়া যাইতে পারে। এই কারণে অস্বাভাবিক মৃত্যু সর্বদাই অপ্রত্যাশিত।
হজরত আলী রা. বলিয়াছেন, 'মৃত্যুর মতো সত্য আর আশার মতো মিথ্যা আর নাই!' তবে মৃত্যুকে আমরা 'সত্য' মানিতে রাজি, কিন্তু 'আশা' ছাড়িতে রাজি নই! আমরা আশা করিতে চাই এই জায়গাটিতে যে, কাহারো অপমৃত্যু কিংবা গণমৃত্যু যাহাতে সংঘটিত না হয়, সেই বিষয়ে সকলে সতর্ক, সজাগ থাকিবে। মনে রাখিতে হইবে, প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান, প্রতিটি প্রাণই পৃথিবীকে ব্যালান্স করিবার কাজটি করিয়া যাইতেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। সুতরাং, এই মহামূল্যবান প্রাণ যেন অস্বাভাবিকভাবে ঝরিয়া না পড়ে, সেই ব্যাপারে আরো বেশি সচেতন হইতে হইবে।