আচরণ ও কথাবার্তা বিশ্বব্যাপী নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তিনি এখন পর্যন্ত যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাও উত্তাপ ছড়াচ্ছে বিশ্বরাজনীতিতে। বিশেষ করে, 'গ্রিনল্যান্ড ইস্যু' নিয়ে তার বক্তব্য-বিবৃতি ইউরোপের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে এক নতুন আলোড়ন।
ইউরোপের বিভিন্ন কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদরা এতদিন বলতেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করুন, কিন্তু তার কথাবার্তাকে আক্ষরিক অর্থে নেবেন না।' তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সম্ভবত আক্ষরিকভাবে নেওয়ার কিছু নেই। অর্থাৎ, তার কথাবার্তাকে হালকা করে না দেখে বরং 'বিশেষ গুরুত্ব' সহকারে আমলে নিতে হবে। এর কারণ, ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প মুখে যা বলবেন, তা-ই করবেন বলেই অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান!
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা হুট করেই গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করার হুংকার দিয়ে বসেন ট্রাম্প। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল, এটা কেবলই কথার কথা। বিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সত্যিকার অর্থেই গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ বানাতে চান তিনি। অর্থাৎ, ট্রাম্পের ঐ কথা বা ঘোষণা কেবলই সাধারণ কৌতুক বা রাজনৈতিক খেলা ছিল না, বরং বাস্তবিকভাবেই এই অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তৎপর হয়েছেন তিনি।
দিন কয়েক আগে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডরিকসেনের সঙ্গে 'এক দীর্ঘ ও উত্তপ্ত' ফোনালাপ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ঐ আলোচনাতেও তিনি গ্রিনল্যান্ড প্রসঙ্গে নিজের আকাঙ্ক্ষার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে চলা সেই কথোপকথনে তিনি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন। শুধু তা-ই নয়, গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হওয়ার জন্য ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডরিকসেনকে রীতিমতো চাপ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফ্রেডরিকসেন যখন সাফ জানিয়ে দেন যে, 'গ্রিনল্যান্ড বিক্রির কোনো প্রশ্নই ওঠে না', তখন অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ট্রাম্প! তৎক্ষণাৎ হুমকি দিতে শুরু করেন এই বলে যে, যদি ডেনমার্ক তার অবস্থান পরিবর্তন না করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি না হয়, তাহলে তিনি ডেনমার্কের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য কড়া বাণিজ্য শুল্ক আরোপের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এতটুকু পর্যন্তও সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি আরো গুরুতর ও জটিল হয়ে ওঠে, যখন ট্রাম্প সরাসরি ডেনমার্কের সামরিক শক্তিকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেন।
ডেনমার্ক সম্প্রতি আর্কটিক অঞ্চলে তাদের সামরিক বাজেট উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি করেছে। বেশকিছু নতুন সামরিক জাহাজ ও ড্রোন যুক্ত করেছে সেনা বহরে। এতে করে এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরো শক্তিশালী হবে বলে তাদের আশা। কিন্তু ট্রাম্প তাদের এ ধরনের পদক্ষেপকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন।
আর এজন্য ডেনমার্কের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে 'ডগ-স্লেজ প্রতিরক্ষা' বলে অভিহিত করতেও ছাড়েননি তিনি। তার মতে, গ্রিনল্যান্ডের মতো একটি বিশাল ভূখণ্ডের নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক ঘাঁটির তুলনায় তা একেবারেই তুচ্ছ। কথাবার্তায় তিনি এমনও বোঝাতে চেয়েছেন যে, ডেনমার্কের সামরিক শক্তির তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এতটাই বেশি যে, যদি তিনি চান, খুব সহজেই গ্রিনল্যান্ডকে নিজের দখলে নিয়ে নিতে পারেন।
সত্যি বলতে, ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্য ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য স্বভাবতই অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ ধরনের আচরণ এক ধরনের সরাসরি সামরিক হুমকি প্রদানের শামিল।
ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া সাধারণত অত্যন্ত কঠোর হতে দেখা যায়। কোনো একটি শক্তিধর রাষ্ট্র যদি অন্য কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে তা ঐ রাষ্ট্রের (স্বাধীন) জন্য স্বভাবতই চিন্তার বিষয়! এ ধরনের পরিস্থিতি বিশেষত ইউরোপের দেশগুলোর-যারা নিজেদের গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের 'অন্যতম প্রধান রক্ষক' হিসেবে দেখে, জন্যও 'এক অতি গুরুত্বপূর্ণ' মুহূর্ত। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ট্রাম্পের এহেন আচরণের পরও ইউরোপের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত নীরব ও নিষ্ক্রিয় বলেই মনে হচ্ছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কোস্তার মতো ব্যক্তিরা পর্যন্ত মুখে তালা দিয়ে রেখেছেন। এ নিয়ে এখন অবধি তারা কোনো মন্তব্য করেননি। এমনকি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্র এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের মতো বিশ্ব নেতা প্রথমদিকে টুকটাক প্রতিক্রিয়া জানালেও পরে 'পুরোপুরি নীরব' হয়ে গেছেন।
এমন একটি পরিস্থিতিতে অনেকে ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন, গ্রিনল্যান্ড ইস্যুতে ইউরোপ এভাবে নীরব কেন? এর পেছনে অবশ্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। যেমন-
প্রথমত, ইউরোপের দেশগুলো খুব ভালো করেই জানে যে, বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া ক্রমাগত নিজ নিজ বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে তাদের মধ্যে। আর সেই প্রতিযোগিতার 'একটি বড় ক্ষেত্র' হয়ে উঠেছে আর্কটিক অঞ্চল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বরফ গলছে, নতুন বাণিজ্য পথ তৈরি হচ্ছে। এর ফলে দিনে দিনে সন্ধান মিলছে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান খনিজ সম্পদের। ঠিক এ কারণেই এ অঞ্চলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নজর পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। আর সেক্ষেত্রে আর্কটিক ঘিরে নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর দরকার পড়ছে ওয়াশিংটনের।
দ্বিতীয়ত, ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। গ্রিনল্যান্ড ক্রমশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে চরেছে, যেখানে ডেনমার্ক চায় না যে, হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়ুক তারা। ফলে একধরনের রাজনীতি শুরু হয়েছে গ্রিনল্যান্ড ইস্যু ঘিরে।
যাহোক, এ মুহূর্তে ইউরোপের মাথায় মূলত দুই ধরনের আবেগ ভর করেছে বলে মনে হচ্ছে! লক্ষণীয়, একদিকে তাদেরকে বেশ ভীত দেখাচ্ছে, আবার অন্যদিকে তারা ততটা উদ্বিগ্ন নয়, যতটা হওয়ার কথা। একদিকে মনে হচ্ছে, ইউরোপের দেশগুলো ট্রাম্পের কথাবার্তা বা আগ্রাসী আচরণকে ভয় পাচ্ছে। তাদের ধারণা, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যদি তারা কঠোর অবস্থান নেয়, তাহলে তিনি হয়তো বা আরো আগ্রাসী হয়ে উঠবেন। ইউরোপের বিরুদ্ধে গ্রহণ করবেন কঠোর নীতি। অন্যদিকে তারা এটাও ভাবছে যে, চলমান পরিস্থিতির রেশ আর খুব বেশিদূর গড়াবে না। অনেকে এমন বিশ্বাসও করছে যে, ট্রাম্পের এই উত্তেজনাপূর্ণ আচরণ কিছুদিন পরই কমে আসবে। এই 'ট্রাম্প ঝড়' একসময় চলে যাবে। যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা!
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউরোপ যদি শুধু অপেক্ষা করতেই থাকে, তথা তারা যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে নিজেদের ভূখণ্ড রক্ষায় 'সক্ষমতার প্রশ্নে' তারা এক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসছে, আর তা হলো-খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের হুমকির পরও, তথা ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ইউরোপের কোনো একটি সদস্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়ার হুমকি আসার পরও যদি ইউরোপের ঘুম না ভাঙে, তারা যদি জেগে না ওঠে, তাহলে স্বভাবতই ইউরোপের সাধারণ জনগণ এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করবে যে, ঠিক কী ঘটলে ইউরোপের নেতারা ঘুম থেকে জেগে উঠবেন?
• লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ও ইউরোপীয়ান ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের ট্রান্সন্যাশনাল গভর্নমেন্ট স্কুলের খণ্ডকালীন অধ্যাপক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর: সুমৃৎ খান সুজন