যুগে যুগে বহু মহৎপ্রাণ মানুষ এই ধূলিবিশ্বকে বাসযোগ্য করিবার কাজটি করিয়া গিয়াছেন । কেহ যুদ্ধজয় করিয়াছেন, কেহ চিকিৎসায় উন্নতি করিয়াছেন, কেহ-বা আগাইয়া লইয়া গিয়াছেন বিশ্বসাহিত্য, সংস্কৃতি-শিক্ষা বা শিল্পকে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ রহিয়াছে নানা কীর্তি, যাহা তাহাদের অমরত্ব আনিয়া দিয়াছে । কিন্তু আমরা কি এইভাবে ভাবিয়া দেখিয়াছি যে, তাহাদের সঙ্গেও আমরা খুব সহজেই গল্প করিতে পারি, দিতে পারি আড্ডা! কেমন ছিল তাহাদের জীবনাচরণ, কেমন করিয়া তাহারা পথ চলিতেন, কেমন করিয়া সমস্যার সমাধান করিতেন, কেমন করিয়াই-বা হইয়া উঠিলেন জগদ্বিখ্যাত—এই সকল প্রশ্নের উত্তর শুনিতে পারি খোদ তাহাদের মুখ হইতেই! সম্ভব এইভাবে যে, আমরা তাহাদের খুঁজিয়া পাই বই-পুস্তকের পাতা জুড়িয়া, সেইখানে তাহারা এখনো জীবন্ত—ঠিক আমাদের, তথা জীবিত মানুষের মতোই! বইয়ের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসিয়াই আমরা মহান সক্রেটিস হইতে শুরু করিয়া প্লেটো; পাদুয়া, দান্তে হইতে শুরু করিয়া মার্লো; শেক্সপিয়ার, বানার্ড শ হইতে বেনথাম, মিল, মার্কস; সর্বোপরি বিংশ শতাব্দীর আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং, সিগমুন্ড ফ্রয়েড হইতে শুরু করিয়া ইউভ্যাল নোহা হারারি বা নোয়াম চমস্কির দেখা পাইতে পারি!
বই কোনো মৃতবস্তু নয়, বরং ইহা মানবসভ্যতার এক অতুলনীয় সৃষ্টি ও সম্পদ । একটি ভালো বই হইল একটি মহান আত্মার জীবনরূপ । ইহা মানুষের চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতার অবিচ্ছেদ্য প্রতীক। আর এই কারণে পাঠাভ্যাসই মানবজাতির সবচেয়ে দামি সম্পদ। দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করিয়া ব্যক্তিজীবনকে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিবার প্রশ্নে বইয়ের বিকল্প কেবল বই-ই । সুকুমার রায়ের ডাকনাম ছিল ‘তাতা’। শৈশবে ‘রাগ বানাই’ নামক নিজের তৈরি একটি খেলা ছিল তাতার, যাহা অনেকটা এই রকম : হয়তো তাতা কাহারও উপর রাগিয়া আছেন, কিন্তু শোধ নেওয়ার উপায় নাই, তখন তিনি ‘আয়, রাগ বানাই’ বলিয়া সেই ব্যক্তি সম্পর্কে অদ্ভুত সকল গল্প বানাইয়া তাহা বলিয়া বেড়াইতেন । বলা বাহুল্য, সেই গল্পে না থাকিত কোনো বিদ্বেষ, না হিংস্র ভাব । ঐ ব্যক্তির ক্ষতি হইবে, এমন কোনো কথাও থাকিত না, থাকিত কেবল ‘মজার কথা’ । এইভাবে খেলার ভিতর দিয়াই তাহার রাগ পানি হইয়া যাইত, যাহা সকল যুগেই শিশু-কিশোর হইতে শুরু করিয়া বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য পর্যন্ত শিক্ষণীয় । এই ধরনের শিক্ষা কেবল বই পড়িয়া লাভ করিতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হইল, আমরা কি পড়িতেছি; পড়িলেও, কী পড়িতেছি!
আজ হইতে মাসব্যাপী গ্রন্থমেলা শুরু হইল । বাঙালির প্রাণের এই মেলার উদ্দেশ্য হইল, বইয়ের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করাইয়া দেওয়া, তাহাদের বইয়ের কাছে ফিরাইয়া আনা । বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা, আমাদের আবেগিত মনের অনুভূতি আদান-প্রদানের মেলা । ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ' শীর্ষক প্রতিপাদ্যকে ধারণ করিয়া মাসব্যাপী চলিবে এই ‘অমর একুশে বইমেলা' । প্রতিবারের ন্যায় এইবারও মেলায় নিশ্চয়ই লেখক-প্রকাশক-পাঠকের ঢল নামিবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে । শিক্ষা-সংস্কৃতির উৎকর্ষসাধন তো বটেই, এই মেলার অর্থনৈতিক দিকটিও গৌণ নহে । তবে একটি বিষয় আমরা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনিতে চাহি, উহা হইল— মেলায় বিদেশি বইয়ের সংখ্যা আরো বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হউক। মহান ফেব্রুয়ারি আমাদের ‘বাংলা’ ভাষাকে আন্তর্জাতিক মান ও মর্যাদা আনিয়া দিয়াছে, এই ভাষা এখন সারা বিশ্বের ভাষা । তাহা ছাড়া কোনো ভাষাকেই আটকাইয়া রাখা যায় না। সুতরাং, ‘ফেব্রুয়ারির বইমেলায়’ গ্রহণ করিতে হইবে এবং এই মেলার ভাবকেও ছড়াইয়া দিতে হইবে আন্তর্জাতিক পরিসরে, মেলার আয়োজনে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা রাখিতে পারিলে ভালো হয় । এইবারের বইমেলা প্রাণবন্ত হইয়া উঠুক। মেলা প্রাঙ্গণ হইয়া উঠুক বইয়ের পাহাড়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৫ সফল ও সার্থক হউক ।