রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

মানুষের জীবনের মূল্য এতটাই কম?

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬:০৫

বিজ্ঞজনেরা বলিয়া থাকেন, ‘অমানুষ' বলিয়া অন্য কোনো প্রজাতি নাই—ইহারা মনুষ্যসমাজেরই অংশ। যাহাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জ্ঞানের অভাব থাকে, যাহাদের অন্তরে মানবিক কোনো গুণাবলির চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যায় না, তাহারাই সাধারণত সমাজের চোখে ‘অমানুষ' হিসাবে আখ্যায়িত। ব্যাপক অর্থে বলিতে গেলে, কোনো মানুষ যখন আরেক মানুষকে কষ্ট দেয়, বিবেক-বুদ্ধি না খাটাইয়া বরং স্বেচ্ছাচারিতা দেখাইয়া মানুষের অধিকার হরণ করিয়া লয়, সেই মানুষই হইল ‘অমানুষ’।

অনেকে অবশ্য ইহাও বলিয়া থাকেন যে, দরিদ্রতা মানুষকে ‘অর্ধমানব’ বানাইয়া দেয়। এই ধরনের কথা যাহারা বলেন, তাহাদের যুক্তি হইল, প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে একটা ‘অমানুষ' বাস করে এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করিয়া সেই 'অমানুষ' জাগিয়া উঠে। সভ্যতার বিবর্তনের পাশাপাশি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ পরিণত হয় অমানুষে!

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটিয়াছে। সমাজ-জীবন হইয়া পড়িয়াছে স্থবির। কোনোখানেই যেন আইনশৃঙ্খলার বালাই নাই। ঠিক এমন একটি পটভূমি বা পরিস্থিতির সুযোগ লইয়া চারিদিকে অমানুষ জাগিয়া উঠিবে—ইহাই স্বাভাবিক। পত্রপত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলিতে প্রতিদিন সেই চিত্রই অধিক দৃষ্টিগোচর হইতেছে। তবে কিছু ঘটনা যেন অমানবিকতার মাত্রাকেও ছাড়াইয়া যাইতেছে!

সম্প্রতি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ভ্যান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে শিশুহত্যার একটি লোমহর্ষক ঘটনা সামনে আসিয়াছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর হইতে জানা যায়, হত্যার শিকার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া রিফাত মাত্র ১২ বৎসর বয়সেই অনটনের সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আনিতে পড়াশোনার পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ভাড়ায় ভ্যান চালাইত। কায়ক্লেশে দিন কাটিয়াও যাইতেছিল তাহাদের; কিন্তু বিধিবাম! রিফাতের বয়স খুবই কম হওয়া খুব সহজেই সে দুষ্কৃতকারীদের টার্গেটে পড়িয়া যায়। ভ্যান ছিনতাইয়ের জন্য তাহাকে গলা কাটিয়া হত্যা করা হয়। হত্যার সাত দিন পর নিখোঁজ রিফাতের মাটিচাপা মরদেহ উদ্ধার করা হয় বড়গ্রাম ইউনিয়নের নরকোনা মধ্যপাড়া গ্রামের একটি সরিষার খেত হইতে। অভিযুক্তরা অবশ্য ইতিমধ্যে মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হইয়াছে। দুষ্কৃতকারীরা সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি হইবে বলিয়া সকলের ন্যায় আমাদেরও প্রত্যাশা।

এই ধরনের ঘটনা বর্তমানে প্রায়ই ঘটিতেছে। রাজধানীর হাতিরঝিলে সম্প্রতি এক স্কুলছাত্রীর ‘হাত-পা বাঁধা’ লাশ উদ্ধার করা হইয়াছে। অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তি হইতে জানা যায়, পাঁচ জন মিলিয়া প্রথমে তাহাকে ধর্ষণ করা হয় এবং হত্যার পর তাহার লাশ ফেলা হয় হাতিরঝিলে। রিফাতের মতো এই মেয়েটিও ছিল শিশু; কেবল অষ্টম শ্রেণিতে উঠিয়াছিল। মা-বাবার নিকট হইতে বিদায় লইয়া কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বাহির হইয়াছিল; কিন্তু আর ফিরিয়া আসে নাই! উল্লেখ্য, শিশু রিফাত হত্যার শিকার হয় যেই ভ্যানের কারণে, সেই ভ্যানটি হত্যাকারীরা মাত্র ১৮ হাজার টাকায় বিক্রয় করিয়াছিল। একইভাবে হাতিরঝিলের ঘটনাটিও যেন নেহাত ‘শখের বশে হত্যা'!

সত্যি বলিতে, বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের বহু ঘটনা ঘটিতেছে ভিতরে ভিতরে—চলমান বাস্তবতায় অনেক ঘটনা হয়তো-বা সামনে আসতিছে না! খুব ছোট্ট কোনো বিষয় হইতেই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক সকল ঘটনা ঘটিয়া যাইতেছে। প্রশ্ন হইল, মানুষের জীবনের মূল্য কি আসলেই এত কম? মাত্র কয়েক শত বা হাজার টাকার জন্য মানুষ মানুষকে হত্যা পর্যন্ত করিতে দ্বিধা করিতেছে না! এই প্রবণতা দেশ বা সমাজের কতটা অশনিসংকেত, সচেতন ব্যক্তিমাত্রই উপলব্ধি করিতে পারেন।

এই উপমহাদেশের একটি জনপ্রিয় গানের শুরুর দিকের কয়েকটি লাইন হইল, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই/ মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই/ এই মানুষের ভিড়ে আমার সেই মানুষ নাই।' সত্যি বলিতে, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে; কিন্তু সেই অনুপাতে ‘মানুষ' বাড়ে নাই। সুতরাং, সমাজে সুষ্ঠু-স্বাভাবকিভাবে বসবাস করিতে হইলে আমাদের মূল লক্ষ্য হইতে হইবে ‘মানুষ সৃষ্টি করা’।

অন্যথায়, যত যাহাই করা হউক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিবে না বলিয়াই অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়। কেহ যেন পরিস্থিতির সুযোগ লইয়া সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে অনিষ্ট বহিয়া আনিতে না পারে, সেই জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আরো অধিক সতর্ক, সজাগ থাকিতে হইবে। সর্বদা মনে রাখিতে হইবে, সতর্কতার মাইর নাই!

ইত্তেফাক/এসএএস

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib