স্কটিশ দার্শনিক টমাস কার্লাইলের মতে, 'শ্রমই জীবন। শ্রমিকের অন্তরের অন্তস্তল হইতে তাহার ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তির উদ্ভব হয়। শ্রম হইল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের দ্বারা তাহার মধ্যে ফুঁকে দেওয়া সেই পবিত্র স্বর্ণীয় জীবন-সারাংশ (পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, ১৮৪৩)। এই জন্য কোনো কাজকেই খাটো করিয়া দেখিবার অবকাশ নাই এবং কোনো স্পোকে উচ্চতর বলিয়া বিবেচনা করা বা কোনো কাজের সহিত কোনো ধরনের বৈষম্য প্রদর্শন করা অনুচিত।
কেননা সমাজ-সংসারে নানা ধরনের কাজই প্রয়োজনীয়। তাহা ছাড়া কাজ নিজেই একটি মর্যাদা। এই জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র এবং মহাত্মা গান্ধীসহ সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিকগণ শ্রমের মর্যাদার বিশিষ্ট সমর্থক।
এই পৃথিবীতে যাহাদের প্রাণ আছে, তাহাদের প্রত্যেকের খাদ্যের প্রয়োজন হয়। কাহারো মতে, পৃথিবী নামক এই গ্রহে প্রাণীর সংখ্যা ৮০ হাজার। স্থলভাগে ৪০ হাজার, আর পানিতে ৪০ হাজার। এই ৮০ হাজার প্রাণিজগতের পানাহারের দায়িত্ব স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার। পবিত্র আল-কুরআনে বলা হইয়াছে: 'পৃথিবীতে বিচরণশীল সকল প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলার' (সূরা: হুদ, আয়াত: ৬)।
তবে সকল প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব নেওয়ার অর্থ ইহা নহে যে, তিনি একসময় আসমান হইতে বনি ইসরাইলদের জন্য সরাসরি প্রদত্ত মান্না ও সালওয়ার মতো খাদ্য সকলের জন্য সরবরাহ করিবেন; বরং প্রাণীকে তাহার রিজিকের জন্য চেষ্টাচরিত্র করিতে হয়। এক কথায় শ্রম দিতে হয়। এই জন্য শ্রম হইল সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মানবজাতির জন্য এক অমূল্য শক্তি ও সম্পদ। তাই মহান আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে' (সুরা বালাদ ৪)।
বলা বাহুল্য, শ্রম ছাড়া পৃথিবীতে কোনো কিছুই অর্জন করা যায় না। শ্রমই হইল সকল উন্নয়ন ও উৎপাদনের চাবিকাঠি। যেই জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সেই জাতি তত বেশি উন্নত। উন্নত দেশসমূহ কাজ বা শ্রমের মর্যাদা দেয় বলিয়াই তাছারা আজ এত সফল ও অগ্রগামী। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) বলিয়াছেন যে, যে মানুষ যত অধিক কর্তব্যনিষ্ঠ, তাহার সফলতা তত বেশি। এই জন্য শ্রম বা কাজকে নবিদের সুন্নত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। প্রত্যেক নবিই জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো না কোনো কাজ করিয়াছেন। তাহারা অলস বসিয়া থাকেন নাই বা কাহারো দয়াসাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করেন নাই। তাহাদের কেহ কেহ ছিলেন কৃষিজীবী, কাঠমিস্ত্রি, কর্মকার, দরজি, ব্যবসায়ী, মেষ বা ছাড়ল-ভেড়ার রাখাল ইত্যাদি।
তাহারা নিজেরা স্বাবলম্বী ছিলেন এবং ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে কোনো বিনিময় গ্রহণ করেন নাই। একই কারণে মহানবির (সা.) সাহাবিরাও বিনা শ্রমের উপার্জনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করিতেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নামাজ আদায়ের পরেই জমিনে ছড়াইয়া পড়িতেন তাহার অনুগ্রহ বা জীবিকা অন্বেষণের জন্য। কেননা তাহারা জানিতেন, জীবিকা অন্বেষণ করা (অপরাপর) ফরজ আদায়ের পর আরেকটি ফরজ' (মিশকাত, বায়হাকি, পৃষ্ঠা ২৪২)।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তির নিজ হাতের কাজ বা কামাই হইল উত্তম উপার্জন। এই জন্য ভিক্ষা করাকে নিরুৎসাহিত করা হইয়াছে। আর শ্রমিককে আখ্যায়িত করা হইয়াছে আল্লাহর বন্ধু হিসাবে। তাই শ্রম মানবজীবনের এক অপরিহার্য বিষয়। তবে শ্রম দিতে হইবে বুদ্ধিমত্তার সহিত। এই জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করিতে হইবে।
কাজেকর্মে সততা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হইবে। সর্বোপরি শ্রমের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য কামনা করিতে হইবে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। কারণ জীবন-জীবিকার মালিক তিনিই। এই জন্য নামাজ আদায়কালে প্রত্যেক ওয়াক্তের প্রত্যেক রাকায়াতে সুরা ফাতিহায় আমরা বলিয়া থাকি: ইয়্যাকা না'বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতায়িন। অর্থাৎ আমরা কেবল আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাহার নিকটই সাহায্য চাই।
অতএব, আমরা যদি সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকিয়া ও ভরসা রাখিয়া পরিশ্রম করি, তাহা হইলে সাফল্য আমাদের ধরা দিবেই। কেননা তিনি যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে 'বিগাইরি হিসাব' বা হিসাবের বাহিরেও ধনসম্পদ বা মানমর্যাদা-প্রতিপত্তি ইত্যাদি প্রদান করিয়া থাকেন। তাই সকল শ্রম ও বৈধ পেশার প্রতি আমরা সম্মান বজায় রাখিয়া চলিব এবং কঠোর পরিশ্রম করিব-ইহাই হউক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।