যুদ্ধ পৃথিবীর এক ভয়াহব বাস্তবতা। আমরা যতদূর পর্যন্ত মানবজাতির অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানিতে পারি, তাহার অনেকাংশ জুড়িয়া রহিয়াছে যুদ্ধের ইতিহাস। সভ্যতার ক্রান্তিলগ্ন হইতে এ পর্যন্ত মানুষ যতটা সভ্য হইয়াছে, তাহাদের জীবনযাত্রার মান ততই উন্নত হইয়াছে; কিন্তু ইহার বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে যুদ্ধ আরো অধিক বিধ্বংসী ও নিষ্ঠুর হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু একটি বিষয় পরিবর্তন হয় নাই, তাহা হইল মানুষের নীতিগত স্বার্থ।
পূর্বের ন্যায় এখনো, পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ বাধিলে যুদ্ধরত দুই পক্ষের বাহিরে তৃতীয় আরেকটি পক্ষ থাকে, যাহাদের মধ্যে কেহ কেহ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের জীবন বিপন্ন করিতে দ্বিধাবোধ করে না, আবার কেহ কেহ মানবতার জন্য নিজের জীবন বাজি রাখিতে পিছপা হন না। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও এমন চিত্র দেখা যাইতেছে। একদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যুদ্ধাহত মানুষের জন্য কাজ করিতেছে, অন্যদিকে কিছু অনৈতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই সুযোগে মানুষ পাচারের মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হইয়াছে। সেটিও আবার বাংলাদেশের মতো এমন একটি দেশে হইতেছে, যেই দেশের চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো নীতিগত স্বার্থ নাই।
পত্রিকা মারফত জানা যায়, ১০ জন বাংলাদেশি যুবককে সৌদি আরব লইয়া সেইখান হইতে আবার রাশিয়ায় পাচার করা হইয়াছে। তাহাদেরকে 'চকলেট কারখানা', 'ফুলের বাগানের কাজ' বা 'নিরাপদ পেশার' কথা বলিয়া উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখাইয়া প্রতারণা করা হইয়াছে। এরপর রাশিয়ায় লইয়া ১৫ দিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হইয়াছে তাহাদের। এই প্রক্রিয়ায় যাহারা যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন না, তাহারা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বাধার সম্মুখীন হইয়া উপায়ান্তর না দেখিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে যাইতে বাধ্য হইতেছেন। ইহার মাধ্যমে তাহাদেরকে যুদ্ধে আহত বা নিহতের সংখ্যা কৌশলগতভাবে বৃদ্ধি করার এক প্রক্রিয়াকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হইতেছে, যাহা কেবল আমাদের দেশের নাগরিকের জীবনকেই বিপদগ্রস্ত করিতেছে না, আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে আমাদের জাতির সম্মানকেও কলঙ্কিত করিতেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপ ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা করিতেছে, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া সেনা সহযোগিতা দিতেছে রাশিয়াকে। তাহাদের এমন পদক্ষেপের পেছনে স্বার্থান্বেষী ছোঁয়া বিদ্যমান। তবে বাংলাদেশের সরাসরি কোনো নীতিগত স্বার্থ না থাকিলেও, কিছু অসাধু চক্র 'চাকুরি' দেওয়ার নামে আমাদের দেশের সহজ-সরল মানুষকে অবৈধভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলিয়া দিতেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার যখন ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালাইতেছিল, তখন অস্কার শিন্ডলার নামের এক জার্মান ব্যবসায়ী নিজের পয়সা দিয়া ইহুদি ক্রয় করিয়া তাহাদের মুক্ত করিয়া দিতেন। এমনকি তিনি তাহাদের মুক্তির জন্য একটি কারখানা খুলিয়া তাহাদের কাজের ব্যবস্থা করিয়া দেন, যাহাতে কাজ করানোর মাধ্যমে মৃত্যু হইতে তাহাদের মুক্তির সুযোগ নিশ্চিত করা যায়। পৃথিবীর প্রায় সকল যুদ্ধের সময় যখনই সংকট তৈরি হইয়াছে, তখনই সৎ মানুষেরও আবির্ভাব ঘটিয়াছে। সেই সকল মানুষের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করাইয়া দেয়, সংকটময় মুহূর্তে মানুষের উদারতা কতিপয় অনৈতিক গোষ্ঠীর লোভের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ হইয়া দাঁড়ায়।
যুদ্ধ চলাকালীন মানবতার সংকট একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কারণ যুদ্ধ কেবল রণক্ষেত্রেই নয়, ইহা ভিন্ন কোনো ভূখণ্ডেও সংকট তৈরি করিতে পারে। আমাদের দেশে সেই সংকট তৈরি হইয়াছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত মানব পাচারের সহিত জড়িত এই সকল অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গড়িয়া তোলা। শুধু সরকার নহে, এই ধরনের কার্যকলাপ প্রতিহত করিতে সমাজের প্রতিটি স্তরে ব্যক্তি পর্যায়েও সচেতন থাকা অতীব জরুরি।