রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

মানুষ কখন বুঝিতে পারে—অধিকার কী জিনিস?

আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৫২

মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় অধিকারের ধারণাটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিয়া আসিয়াছে। ব্যক্তির এবং সমাজের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য 'অধিকার' বিষয়টি অপরিহার্য; কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে দেখা যায়, অধিকারের ধারণা সকল সময়ে সুস্পষ্ট ও সুসংহত ছিল না। প্রাচীনকালে সমাজব্যবস্থা শ্রেণিকেন্দ্রিক ও বর্ণাশ্রমভিত্তিক থাকায় অধিকারের প্রশ্নটি কেবল নির্দিষ্ট শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত ছিল। মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে সাধারণ জনগণের অধিকার প্রায় অস্বীকৃত ছিল। ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) সময় ‘স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী' স্লোগানের মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা অধিকতর বিস্তৃতি লাভ করে। জ্যা জ্যাক রুশো বলিয়াছিলেন, “মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন; কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত। আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনের ক্ষেত্রেও জন লকের প্রভাব অপরিসীম; তিনি বলিয়াছিলেন, ‘জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষা করাই রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব।'

তবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে অধিকারের সচেতনতা গঠনের প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট জটিল ও বেদনাদায়ক। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক পরাধীনতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং শিক্ষার অভাব এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে প্রকৃত অধিকারবোধ জন্মাইতে দেয় নাই। বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরও প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করিতে পারে নাই। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি, দমননীতির কারণে জনগণ অধিকার সম্পর্কে অবগত হইবার সুযোগ পায় নাই; কিন্তু যখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার হয়, তখনই তাহারা অধিকার সম্পর্কে সচেতন হইয়া উঠে এবং প্রতিরোধ গঠনের প্রয়াস গ্রহণ করে।

এখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর গায়ে যখন আঁচড় লাগিতেছে, তখন তিনি বা তাহারা অধিকার বিষয়ে নড়িয়া-চড়িয়া বসেন। তাহার মধ্যে প্রতিশোধের জন্য আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, সেইখান হইতে সৃষ্টি হয় প্রতিরোধ। দুঃখজনকভাবে, অরাজক পরিস্থিতিতে যেই খেলা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে শুরু হইয়াছে, যাহাদের বয়স এখন পঞ্চাশোর্ধ্ব, তাহারা জীবদ্দশায় এই খেলার সমাপ্তি হয়তো দেখিয়া যাইতে পারিবেন না। ত্রাস সৃষ্টি করিয়া শাসন করিবার যেই মানসিকতা এতদিন, যুগ যুগ ধরিয়া তৃতীয় বিশ্বের মানুষ দেখিয়াছে, শুনিয়াছে; কিন্তু সেই ত্রাসের আগুন যদি সরাসরি নিজের ঘরে লাগে, তখন মানুষ সচেতন হইয়া উঠে নিজের অধিকারের ব্যাপারে। জ্ঞানী-গুণীরা বলিয়া থাকেন—দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকিয়া যায়, তখন তাহার আর পিছাইবার পথ থাকে না। কিংবা বলা যায়, কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে যদি ঠেলিয়া ঠেলিয়া দেওয়ালে ঠেকাইয়া দেওয়া হয়, তখন রুখিয়া দাঁড়ানো ব্যতীত তাহার আর উপায় থাকে না। ইহা সকল কালে সকল সময়, সকল পক্ষের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং যাহারা যখন অন্যকে দেওয়ালে ঠেলিয়া দিতে চাহে, তাহারা মূলত সেই পক্ষকে নিজেদের অধিকারের ব্যাপারেই সচেতন হইতে বাধ্য করে।

অধিকারের প্রশ্ন কেবল আইন ও রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে, ইহা এক সামাজিক, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্বও বটে; ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রয়াসেই অধিকারের প্রকৃত সুরক্ষা সম্ভব। যাহারা অধিকার রক্ষা করিতে সচেষ্ট, তাহাদের প্রতিনিয়ত লড়াই করিতে হয়, কারণ ইতিহাস সাক্ষী যে অধিকারের পথ কখনো সহজ ছিল না। অধিকার কোনো দয়ার দান নহে— ইহা প্রতিটি মানুষের জন্মগত দাবি; কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের মানুষ ইহা সাধারণত ভুলিয়াই থাকে। নিজের অধিকার, নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ যুগের পর যুগ ধরিয়া শুনিয়া আসিয়াছে। দশকের পর দশক ধরিয়া অধিকারের জন্য আন্দোলনও করিয়াছে; কিন্তু অধিকার কী? অধিকাংশ মানুষ তাহাই জানে না। একটি রাষ্ট্র তখনই প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক ও সভ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে, যখন তাহার নাগরিকগণ তাহাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকে এবং রাষ্ট্র তাহা রক্ষা করিবার দায়িত্ব গ্রহণ করে। নচেৎ, সমাজে প্রতিরোধ সৃষ্টি হওয়া অনিবার্য। মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলিয়াছিলেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে অসম্মতি জানানো মানে সেই অন্যায়কে সমর্থন করা।' মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের এই কথাটিও সর্বকালে, সকল সমাজে, সকল পক্ষের জন্যই প্রযোজ্য।

ইত্তেফাক/এনএন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib