ভৌগোলিক কারণে প্রতি বছর শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত শুরুর আগে থেকেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়েছে এবং দূষণের দিক থেকে প্রায়ই প্রথম হচ্ছে। বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বায়ুর মান এতটাই খারাপ থাকে যে, এই পাঁচ মাসে সারা বছরের প্রায় ৬৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। গত আট বছরের চেয়ে গড়ে গত এক বছরে ১০ ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একটা বড় শঙ্কার বিষয়। বিশ্বের প্রভাবশালী স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশদূষণের কারণে ঘটা মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর রাজধানী ঢাকা তো অনেক বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য ও নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটি।
এ বছরের নভেম্বর থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতি তিন দিনের মধ্যে যে কোনো এক দিন ঢাকা শহরের বায়ুর মানসূচক ৩৩০-এর ওপরে থাকছে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে ঢাকা একাধিক বার ৩০০-এর বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিত শহরের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ থেকে ঢাকার বায়ুদূষণের অবস্থান সহজেই অনুমেয়।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস গ্রহণ এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে অকালে মৃত্যুর শতকরা ৮৯ ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে হয়ে থাকে। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ। পরিবেশগত কারণে ও গৃহস্থালিসংক্রান্ত কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণের প্রভাবে প্রতি বছর ৬৭ মিলিয়ন মানুষের অকালমৃত্যুর সঙ্গে জড়িত। এক গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু অধ্যুষিত এলাকায় বাস করে, যার মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশুদ্ধ বাতাস সুস্থতার অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক। খাবার, পানি বা বাসস্থান ছাড়া আমরা কিছু সময় থাকতে পারলেও নিশ্বাস গ্রহণ ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারি না। তাই, বায়ুদূষণের প্রকৃতি এবং রোধের উপায় জানা খুবই প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও শিল্পঘন শহরগুলোতে মোট ১১টি সার্বক্ষণিক বায়ু মনিটরিং স্টেশনের (CAMS ) -এর মাধ্যমে বায়ুদূষণের উপাদানসমূহের (বস্তুকণা, ওজোন, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি) পরিমাণ নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।
বায়ুর মান সূচকের রিপোর্ট করার জন্য ০-৫০ (ভালো), ৫১-১০০ (মাঝারি ভালো), ১০১-১৫০ (সাবধানতা), ১৫১-২০০ ( অস্বাস্থ্যকর), ২০১- ৩০০ (খুব অস্বাস্থ্যকর) এবং ৩০১-৫০০০ ( তীব্র অস্বাস্থ্যকর) এই স্কেল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত অছও-এর মাত্রা ২০০ অতিক্রম করলে স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা বেতার/টিভিতে প্রচার করা হয়ে থাকে।
বর্ধিত জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, যানবাহন ও কলকারখানার পাশাপাশিঅপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম বায়ুদূষণের উৎস হিসেবে কাজ করে। মূলত বায়ুতে মাত্রাধিক সূক্ষ্ম বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM2.5 I PM10), কার্বন মনোক্সাইড (CO), কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO,), সালফার অক্সাইডসমূহ (SOX), নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ (NOX), ওজোন (O3) উপস্থিতি, বস্তুকণা; যেমন—নাইট্রেট, সালফেট, এমোনিয়া, কালো কার্বন, এন্ডোটক্সিন এবং সূক্ষ্ম ধাতব কণাগুলো; যেমন—লোহা, কপার, নিকেল, জিংক ইত্যাদি; ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (CFC), ব্যাটারি, পেট্রোল, ডিজেল, হেয়ার ডাই থেকে নির্গত সিসা বায়ুদূষণের কারণ।
বায়ুদূষণের প্রধান কারণসমূহের মধ্যে : "অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন, বাড়ি কলকারখানার দূষিত ও রাসায়নিক পদার্থ নির্গমন, ইটভাটা থেকে নির্গত সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার), বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, নাগরিক অসচেতনতা, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার ধোঁয়া, পরিত্যক্ত বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া, রান্নার কাজে নির্গত ধোঁয়া ও কয়লা পোড়ানো, টায়ার পোড়ানো, কৃষিক্ষেত্রে আগাছ নাশক, কীটনাশক, জৈব ফসফেট এবং ক্লোরিনযুক্ত হাইড্রোকার্বন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণ, জৈব ও অজৈব পদার্থের স্বাভাবিক পচনে সৃষ্ট গ্যাস, দাবানল ও ধূলিঝড় বায়ুকে দূষিত করে।
বায়ুদূষণে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা : বিশেষত শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী বায়ুদূষণে বেশি আক্রান্ত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উচ্চমাত্রার দূষিত বায়ুসেবনে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, কার্ডিওভাসকুলার, ক্রনিক ব্রংকাইটিস, অবসট্রাকটিভ পালমোনারি (স্ট্রোক এবং হার্ট ফেইলিওরের প্রায় ২৩ শতাংশ ও ৩২ শতাংশ কারণ এ বায়ুদূষণ), প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ ফুসফুস ক্যানসারের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ থেকে আসা কার্সিনোজেন।
World Health Organization (WHO)- এর আরেক তথ্যানুযায়ী ৯০ ভাগ মানুষ দূষিত বায়ু গ্রহণ করছে। শুধু বায়ুদূষণের কারণে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এছাড়াও WHO-এর অন্য তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর বায়ুদূষণের ফলে ২১ ভাগ নিউমোনিয়া, ২০ ভাগ স্ট্রোক, ৩৪ ভাগ হৃদরোগ, ১৯ ভাগ COPD (Chronic Obstructive Pulmonary Disease) এবং ৭ ভাগ ফুসফুসের ক্যানসারের কারণে মারা যায়।
যেসব মানসিক রোগ বায়ুদূষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তার মধ্যে রয়েছে ডিমেনশিয়া, অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, ডিপ্রেশন/বিষণ্ণতা ইত্যাদি। বাতাসে বেনজিন ও কার্বন মনোক্সাইডের উপস্থিতি সিজোফ্রেনিয়া রোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সাউথ কোরিয়ার এক গবেষণায় আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে বাতাসে সালফার ডাইঅক্সাইড ও ওজোনের মাত্রার সম্পর্ক পাওয়া যায়।
বায়ুদূষণরোধে করণীয় :
ক. সিসামুক্ত পেট্রোলিয়াম ব্যবহার নিশ্চিত করা;
খ. তিন চাকার দুই স্ট্রোক-বিশিষ্ট যান চলাচল নিষিদ্ধকরণ এবং মোটরযান থেকে ধোঁয়া নিঃসারণ মানমাত্রার মধ্যে রাখার জন্য প্রতিটি মোটরযানে ক্যাটালাইটিক কনভার্টার বা অক্সিডেশন ক্যাটালিস্ট বা ডিজেল পার্টিকুলেট ফিল্টার সংযোজন বাধ্যতামূলক করা।
গ. জ্বালানিরূপে পরিবেশবান্ধব কমপ্রেশড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) ব্যবহার বৃদ্ধি ঘ. শিল্পকারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণ।
৫. ২০ বছরের পুরোনো বাস রাস্তায় চালানো বন্ধ করা।
চ. ধুলাবালির দূষণ ন্যূনতম ২০ ভাগ শতাংশ কমানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
ছ. শুষ্ক মৌসুমে রাতের বেলা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তা পরিষ্কার করার সময় পানি ছিটানো বাধ্যতামূলক করা।
জ. জ্বালানির মান উন্নয়ন ও রিফাইনারি সক্ষমতা বৃদ্ধি।
ঝ. ঢাকা শহরের ব্যক্তিগত যানবাহন কমাতে হবে এবং যৌথ ব্যবহার করা যায়, এমন যানবাহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ঞ. নাগরিক পর্যায়ে যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী না রাখা, ধুলা সৃষ্টিকারী সামগ্রী ঢেকে রাখা এবং রাস্তার দুই ধারের সবুজায়ন সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
ট. বাংলাদেশের ঋতু এমন যে, ছয় মাস উত্তর দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হয়, বাকি ছয় মাস দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত হয়, তাই ঢাকা শহরের ইটভাটার জন্য স্থান নির্ধারণ করে দিতে হবে, যাতে শহরে দূষিত বাতাস গ্রহণ করতে না পারে।
ঠ. রাজধানীর কিছু এলাকাকে চিহ্নিত করে ঐসব জোনে আর নতুন ভবন নির্মাণ না করার নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। কারণ অধিক ভবনের সঙ্গে জননিবিড়তা ও যান চলাচলের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
ড. ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করা।
ঢ. ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধ্য করা এবং Hollow Brick, Concrete Hollow Block, Thermal Block, Compressed Stabilized Earth Block (CSEB), Interlocking CSEB ইত্যাদির উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
ণ. নগর-গ্রামীণ উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা অবশ্যই হতে হবে পরিবেশবান্ধব।
ত. সড়কের ধুলাবালি/ময়লা পরিষ্কার করার জন্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করতে হবে এবং সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্থানে পানি ছেটানো নিশ্চিত করতে হবে।
প্রাথমিকভাবে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় স্বপ্নের নগরী ঢাকা মৃত্যুপুরী হয়ে উঠবে, অর্থাৎ আমাদের ব্যক্তিগত উদাসীনতা সবার স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে। জনজীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে উন্নয়নকাজের কোনো মানেই হয় না। সচেতনতার বিকল্প নেই। আইন মানার ইচ্ছা না থাকলে শত আইন করেও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
লেখক : যুগ্মসচিব, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়