'কোটা না মেধা? মেধা মেধা, আপস না সংগ্রাম? সংগ্রাম সংগ্রাম'- এবারের বইমেলার প্রবেশমুখে এসব স্লোগানের পোস্টার, জুলাই অভ্যুত্থান শহীদদের ছবি ও স্বৈরাচারবিরোধী গ্রাফিতি যে কারও নজর কাড়বে সহজেই। এবারের মেলার সর্বত্র যেন বইছে জুলাই আন্দোলনের হাওয়া।
মেলাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে স্থাপন করা হয়েছে 'জুলাই চত্বর'। সেখানে উপস্থাপন করা হয়েছে অভ্যুত্থানের চিত্র।
শুধু সাজসজ্জায় নয়, রঙয়ের মাধ্যমেও জুলাই অভ্যুত্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রাফিতি আঁকতে ব্যবহার করা হয়েছে লাল, কালো ও সাদা রঙয়ের ব্যবহার। লাল হচ্ছে বিপ্লবের প্রতীক, কালো শোক এবং সাদা শান্তির প্রতীক।
শুধু গ্রাফিতি নয়, স্টলগুলোতে ঠাই পেয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান সম্পর্কিত বই। প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে আল মাসুদ হাসানউজ্জামানের লেখা ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান: নতুন পথে বাংলাদেশ’, আসিফ নজরুলের লেখা 'শেখ হাসিনার পতনকাল', ‘স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধের পথ: রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান শাসন’।
ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছে 'জুলাইয়ের অশেষ পাখিরা', 'গণ-অভ্যুত্থান চিন্তাশিখা' ও 'হ্যাশট্যাগ জুলাই'। আদর্শ প্রকাশনী থেকে আহম্মেদ ফয়েজের লেখা 'সংবাদপত্রে জুলাই অভ্যুত্থান', ‘জুলাই জাগরণের দিনলিপি’ প্রকাশিত হয়েছে।
মেলায় এই বইগুলোর পাশাপাশি পাঠকদের পছন্দের তালিকায় ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের বই '36 Days of July', 'জুলাই ক্যালাইডোস্কোপ', 'জুলাই গণ অভ্যুত্থান সাক্ষ্য', 'ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান'।
এবারের মেলায় ভিন্নতা এসেছে স্টলগুলোর সাজ সজ্জাতেও। নতুন নতুন থিমে তৈরি করা হয়েছে বইয়ের স্টলগুলো। এরমধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্টলটি। দোতালা বিআরটিসি বাসের আদলে তৈরি করা সেই স্টলের সামনে যাত্রীরা নয়, ভিড় করে আছে বইপ্রেমীরা। এই স্টলটি দেখতে আপনাকে যেতে হবে মেলার একটু ভিতরে।
মেলার আরেকটু ভেতরে গেলে চোখে পড়বে বাঁশ আর বাঁশের চটি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন স্টল। যেটি বসিয়েছে আকাশ প্রকাশনী। এছাড়া মেলায় রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বাসার আদলে সাজানো একটি স্টল। এই স্টলটি তৈরি করেছে ইতি প্রকাশনী। অন্যধারা প্রকাশনী তাদের স্টলটি তৈরি করেছে জাতীয় সংসদ ভবনের আদলে।
জুলাই আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে নির্মাণ করা হয়েছে ‘৩৬ জুলাই’ নামের ফটো বুথ। দূর থেকে মনে হবে এটি আর পাঁচটা বইয়ের স্টলের মতোই তবে সামনে গেলে মিলবে এক ভিন্ন বাস্তবতার। এটি আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই উত্তাল সময়ে যখন প্রতিবাদ ছিল একমাত্র ভাষা। বুথের ভিতর প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে দু হাত প্রসারিত আবু সাঈদের বিশাল আকৃতির ছবি। তার চারপাশে আবার চিত্রায়িত হয়েছে সেই সময়ের বেদনাদায়ক মুহূর্তগুলো—হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, পুলিশের নির্মম নির্যাতন, ছাত্রলীগ কর্তৃক নিগ্রহের দৃশ্য। ইতিহাসের এই দিনগুলো যেন নিঃশব্দে কথা বলে।
এতো গেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কথা। পাশাপাশি বাংলা একাডেমিতে বিস্তৃতি বইমেলাও দৃষ্টি কেড়েছে বইমেলাতে আগত বইপ্রেমীদের। এখানে ঘুরতে আসা পাঠকেদের আকৃষ্ট করেছে ‘বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের স্টলটি। এই স্টলে প্রবেশের পূর্বে দর্শনার্থীদের নজরে প্রথমে আসে সেখানে রাখা ময়লা ফেলার ডাস্টবিন। সেই ডাস্টবিনের স্টিকারের মাধ্যেমে দৃশ্যায়ন করা হয়েছে পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার।
অন্যান্য ডাস্টবিন থেকে এই ডাস্টবিনেই অতিরিক্তি ময়লা নিক্ষেপ করছে মেলাতে আসা দর্শনার্থীরা। হয়ত শেখ হাসিনার প্রতি তাদের ক্ষোভ এবং ঘৃণা থেকে তাদের এই প্রতিক্রিয়া।
শুধু ডাস্টবিন নয়, স্টলটিও সমানভাবে দৃষ্টি কাড়ছে সবার। বিশেষ করে স্টলটির সামনে লেখা ‘মা ও মাতৃভূমির’ লেখাটা বেশি আকৃষ্ট করেছে পাঠকদের। এই স্টলটির আরেকটা বিশেষায়িত হলো জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা অধিকাংশ বই এই স্টলটিতে পাওয়া যাচ্ছে। এরমধ্যে 'ছাব্বিশের গণঅভ্যুত্থান', 'রক্তাক্ত জুলাই', 'জুলাইয়ের গল্প' শিরোনামে বইগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে।
এই স্টলটি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। ‘জুলাইয়ের স্মৃতি ডায়েরি’ নামে একটি কর্ণার করেছে। যেখানে প্রতিদিনই কোনো না কোনো শহীদ পরিবারের সদস্য এসে লিখে যান অভ্যুত্থানের সময়ের অনুভূতি। এই সময় কাছের মানুষকে হারানোর স্মৃতিচারণ করে, তাদের চোখের কোণে ভেসে উঠে জল। যেন হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখগুলোর কাছে আরেকবার ফিরে যাওয়ার এক নীরব প্রয়াস।