মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

এই অব্যবস্থাপনা কি চলিতেই থাকিবে? 

আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৫, ১৬:১৪

পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে নাড়ির টানে সাধারণ মানুষের ঘরে প্রত্যাবর্তন তথা ঈদ যাত্রা আর কয়েক দিন পরই শুরু হইবে। ইতিমধ্যে গত শুক্রবার হইতে ঈদ যাত্রা উপলক্ষ্যে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রয় শুরু হইয়া গিয়াছে। আমরা প্রতি বৎসর দেখিতে পাই, ঈদ যাত্রা আনন্দদায়ক হইলেও অনেক সময় নানা দুর্ঘটনার কারণে তাহা বিষাদে পরিণত হয়। সড়কপথের পাশাপাশি অনেক সময় ট্রেন যাত্রাও হইয়া পড়ে অনিরাপদ ও অনিশ্চিতময়। সড়ক, নৌপথ, রেলপথসহ সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি এইবার নিরাপদ ঈদ যাত্রা নিশ্চিত করিতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করিতে হইবে।

গতকালেরই অনলাইনের একটি খবর। সিগন্যাল পয়েন্টে সমস্যা থাকায় রাজশাহী রেল স্টেশনের ওয়াশপিটের সম্মুখে ঢাকাগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেসকে ধাক্কা দিয়া বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। যদিও ইহাতে দুইটি ট্রেনের একাধিক বগি ক্ষতিগ্রস্ত হইলেও কাহারো হতাহতের খবর পাওয়া যায় নাই, তথাপি স্টেশন এলাকায় এই দুর্ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা জানি, ঈদ যাত্রাকালে ট্রেনের উপর সাধারণ মানুষের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। ঈদ যাত্রার ট্রেনের টিকিট ক্রয়ের জন্য যে হাহাকার পড়িয়া যায়, তাহা এইবার মাত্র আধাঘণ্টায় অনলাইনে ২০ লক্ষ মানুষের হিট দেখিয়াই প্রতীয়মান হয়; কিন্তু এইবারও কি আমরা নিরাপদ ঈদ যাত্রার জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে পারিয়াছি? গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় 'অরক্ষিত ৫৭ লেভেল ক্রসিং'। আশ্চর্যের বিষয় হইল, এইখানকার ৭৩ কিলোমিটার রেলপথে লেভেল ক্রসিং রহিয়াছে ৭৯টি। প্রতি কিলোমিটারে একটিরও অধিক লেভেল ক্রসিং কীভাবে গড়িয়া উঠে? গত এক বৎসরে এই রেলপথে লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনায় ৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটিয়াছে। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নহে, সমগ্র দেশেই এমন বিপজ্জনক লেভেল ক্রসিং রহিয়াছে ভূরিভূরি। আমাদের বক্তব্য হইল, লেভেল ক্রসিং তৈরি করিলে সেইখানে অবশ্যই সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই জন্য প্রয়োজনীয় জনবলও নিয়োগ দিতে হইবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা যায়, ২০১৯ হইতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ বৎসরে সমগ্র দেশে রেলের ১ হাজার ২২৮টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪০৩ জন নিহত এবং ১ হাজার ২৬৯ জন আহত হইয়াছে। পরিসংখ্যান মতে, সমগ্র দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়া প্রায় ৮৪ শতাংশ লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত রহিয়াছে এবং দেশে যত রেল দুর্ঘটনা ঘটে, তাহার ৮৯ শতাংশই ঘটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে আরো জানা যায়, বাংলাদেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রহিয়াছে। তাহার মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। ইহার মধ্যে ৯৬১টি লেভেল ক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। আর ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টির নাই কোনো গেটম্যান। কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও নাই এই সকল অরক্ষিত, গেটম্যানবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে।

উন্নত রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় লেভেল ক্রসিংয়ে রেলপথ ও সড়কপথ আলাদা দুটি লেভেল বা স্তর দিয়া যায়। ফলে সেইখানে ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের সংঘর্ষের কোনো আশঙ্কা থাকে না; কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেই রকম ব্যবস্থা না থাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে গেটবার দিয়া সড়কপথ আটকাইয়া রাখিয়া ট্রেনকে চলিবার সুযোগ করিয়া দিতে হয়। তাই পর্যায়ক্রমে হইলেও এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। আমাদের জানা মতে, অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের অধিকাংশ রাস্তাই এলজিইডি ও ইউনিয়ন পরিষদের। রেল কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এই সকল অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি করে। অনেক জায়গায় বেআইনিভাবে রেললাইন অতিক্রম করিয়া যে যাহার প্রয়োজনে রাস্তা বানাইয়া লইয়াছে। এই নৈরাজ্য চলিতে পারে না। ইহা ছাড়া ভাঙা গেটবারের সংস্কার, সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং লেভেল ক্রসিংয়ের আশপাশে গড়িয়া উঠা বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনার উচ্ছেদ প্রয়োজন। রেলপথের উপর খোদ সরকারেরই নানা সংস্থা যে অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করিয়া থাকে, তাহা খুবই দুঃখজনক। তাই আমাদের প্রশ্ন, এই সকল অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা কি যুগ যুগ ধরিয়া চলিতেই থাকিবে?

ইত্তেফাক/এএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন