মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

জীবনের দাম মাত্র কয়েক টাকা বকশিশ!

আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৯:০৩

যুদ্ধের করাল গ্রাসের শিকার ফিলিস্তিনের গাজার ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করিয়া সকলে একবাক্যে স্বীকার করিবেন যে, এইখানে মানবতার চিহ্নমাত্র নাই! অথচ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া উপত্যকাটির ভাঙাচোরা রাস্তায় যেইখানে চলাচলই দায় হইয়া উঠিয়াছে; সুনসান মহাশ্মশান জুড়িয়া যখন কানে কেবলই বাজিয়া উঠে কাঠের পায়ের খটখট আওয়াজ, সেই ভূতুড়ে পরিবেশে শত প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়াইয়াও অনেকে রচনা করিয়া যাইতেছেন মানবিকতার গল্প! 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানা গিয়াছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার হাজারো প্রতিকূলতাকে বুড়া আঙুল দেখাইয়া রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়া যাইতেছেন হাসান জেইন আল দিন নামক এক চিকিৎসক । প্রাণভয় তোয়াক্কা না করিয়া ভাঙাচোরা রাস্তায় মাইলের পর মাইল সাইকেলে চাপিয়াই রোগীদের দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌছাইয়া দিয়া যাইতেছেন মাসের পর মাস। চিকিৎসক হাসান আল দিনের একটিই লক্ষ্য, যেভাবেই হউক, অসহায় গাজাবাসীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করিতে চাহেন তিনি । যুদ্ধবিধ্বস্ত নিরীহ মানুষের চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগকারী মহান চিকিৎসক জেইন আল দিনের এই প্রাণান্তকর চেষ্টা ও মহৎকর্ম কোনো কিছু দিয়াই মূল্যায়নযোগ্য নহে—ইহা আসলেই এক অমর কীর্তি । হাসান আল দিনের মতো চিকিৎসকরা গাজাবাসীর জন্য তো বটেই, সমগ্র বিশ্বের জন্য আশার আলো।

কিন্তু আমাদের এইখানে কী ঘটিতেছে? এইখানে প্রতিদিন কয়টি মানবতার গল্প রচিত হইতেছে? বরং বলিতে হয়, এই দেশে মানবিকতার ছিটাফোঁটাও যেন অবশিষ্ট থাকিতেছে না! সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে দায়িত্বরত এক আয়া চিকিৎসাধীন এক নবজাতকের অক্সিজেন বন্ধ করিয়া দেন এবং যাহার ফলে স্বভাবতই নবজাতকটির মৃত্যু হইয়াছে । হতবাক হইবার মতো বিষয় হইল, ঐ বুয়া এই গর্হিত কাজটি করিয়াছেন কেবল ‘বকশিশ’ না পাইয়া। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, ঐ আয়াকে চাহিদা অনুপাতে বকশিশ না দেওয়ায় তিনি অক্সিজেনের পানির সরবরাহ বন্ধ করিয়া রাখেন, যাহার কারণে শিশুটি মারা যায়।

একজন মানবশিশুর জীবনের মূল্য বকশিশের ‘মাত্র কয়েকটি টাকা’–ভাবা যায় এই কথা! ঘটনা তদন্তে কর্তৃপক্ষ এইবারও যথারীতি কমিটি গঠন করিয়াছে। অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত হইবে বলিয়া প্রত্যাশিত। দোষীর হয়তো শাস্তি হইবে; কিন্তু যেই মানসিকতা হইতে এহেন নিষ্ঠুর কাজ করিতে দ্বিধা করিতেছেন না, সেই মানসিকতা কী করিয়া দূর হইবে? দোষীদের শাস্তির চাইতেও বড় কথা, কেহ যেন এই ধরনের অপরাধ না করিবার মানবিক মানসিকতা অর্জন করে । তাহা হইলে দোষও করিবে না এবং শাস্তিরও কথা উঠিবে না।

আমরা অতীতে দেখিয়াছি, এই সমস্ত দুর্ঘটনার পর আমরা সচরাচর দিনকয়েক হম্বিতম্বি করি, তদন্তকমিটি গঠন করি, ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসালয়ে হামলা-ভাঙচুর, কিংবা অভিযুক্তকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়; কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ইহার পরের গল্পটা আর জানিতে পারা যায় না, বরং উহা থাকিয়া যায় এক রহস্য হইয়া! কেবল স্বাস্থ্য খাত নহে; বকশিশ, পারিতোষিক, ট্রিট, চা-নাস্তা খরচ ইত্যাদির ন্যায় বাজে সংস্কৃতির প্রচলন রহিয়াছে অন্যান্য সেবামূলক সেক্টরগুলিতেও, যাহা অবিলম্বে পরিত্যাজ্য।

স্বাস্থ্যের ন্যায় সেবামূলক খাতে যাহারা নিয়োজিত রহিয়াছেন, তাহাদের সর্বদা মনে রাখিতে হইবে, ‘লাভ ইজ দ্য বেস্ট ডক্টর'। অর্থাৎ, আদর্শ সেবার এক নাম্বার শর্ত হইল, সেবাগ্রহীতার প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ থাকিতে হইবে। ইহা পেশাদারিত্বের অংশও বটে। প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লেখ রহিয়াছে, ঔষধের চাইতে ‘কথা’ অধিক জরুরি। এই জন্য রোগীকে চিকিৎসা করাইতে হয় ‘কথা’ দিয়া। অথচ আমাদের সেবকরা দাঁত কিটিমিটি করিয়া কেবল প্রেসক্রিপশন লিখিতেই অধিক পছন্দ করেন এবং অধস্তন অনেকে বকশিশ না পাইয়া সংক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হইয়া রোগীর ক্ষতি সাধন হইবে—এমন কাজ করিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। ইহা সত্যিই অপ্রত্যাশিত, অনভিপ্রেত। স্বাস্থ্যসেবা খাতের ন্যায় সেক্টরগুলি হইতে এই সংস্কৃতির অবসান জরুরি।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন