আজকাল মানবজীবনে ক্যারিয়ার গঠনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। ক্যারিয়ার বলিতে আমরা বুঝি প্রফেশনাল লাইফ তথা পেশাগত জীবনকে। এই জন্য প্রত্যেকের জীবনে আজ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ক্যারিয়ার প্ল্যানিং থাকা দরকার। ইহার পর নিজের সেই লালিত স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করিয়া থাকা দরকার ব্যাপক প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির অন্যতম দিক হইল সেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যাপক লেখাপড়া করা তথা তত্ত্বীয় ও ব্যাবহারিক জ্ঞান অর্জন করা এবং অধ্যবসায়, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ করিয়া তোলা। কারণ বর্তমান পৃথিবী প্রতিযোগিতামূলক। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ যে কোনো ক্ষেত্রই হউক না কেন, কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার কোনো বিকল্প নাই। নিজেকে সফলভাবে গড়িয়া তুলিতে নিরন্তর প্রচেষ্টা অপরিহার্য। শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, সামর্থ্য ইত্যাদি অর্জন করিয়াই তবে একদিন সফল ক্যারিয়ারের অধিকারী হওয়া যায়।
আমরা মনে করি, প্রত্যেক মানুষের প্রফেশনাল জীবনের রোডম্যাপ বা মানচিত্র থাকা প্রয়োজন। এই জন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মসচেতনতা, আত্মবিশ্বাস, অভিজ্ঞতা, সততা, দায়িত্বশীলতা, নিয়মানুবর্তিতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা যেমন থাকা দরকার, তেমনি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা, সহমর্মিতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও চাপ মোকাবিলা, সময় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় গুণ ও দক্ষতাও অর্জন করিতে হয়। অর্থাত্ শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি বিশেষ কিছু গুণ ও দক্ষতা অর্জন ব্যতীত বাস্তব জীবনে তেমন সফলতা আসে না। একইভাবে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিশেষ জ্ঞান, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দরকার। বিভিন্ন পেশাগত জীবনে সফলতা অর্জন করা যেমন সহজ নহে, তেমনি দেশ পরিচালনা করাও অত্যন্ত কঠিন। আজকাল উন্নতমানের কাঠমিস্ত্রি এমনকি নাপিত হইতে হইলেও নিবিড় প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করিয়া সিংগাপুর, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন উন্নত দেশ উন্নয়নশীল দেশগুলি হইতে দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তি আমদানির সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহে নিজেরাই প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করিয়া থাকে। এই জন্য বিভিন্ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করে।
অনুরূপভাবে যাহারা রাষ্ট্রপরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করিবেন, তাহাদের বিশেষ জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা কেন থাকিবে না—এই প্রশ্ন করা কি অমূলক ও অযৌক্তিক? শুধু স্লোগান দিতে পারা কিংবা যে কোনো প্রকারে জনগণকে উত্তেজিত বা প্রভাবিত করিতে পারাটাই কি একমাত্র যোগ্যতা ও দক্ষতা হইতে পারে? আমরা উন্নত দেশগুলিতে দেখিতে পাই, রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা প্রসিডিউর বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতে হয়। এই জন্য সিনেটে বিশেষ শুনানিও অনুষ্ঠিত হয়। ইথিকস বোর্ডের মুখোমুখি হইতে হয়। তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ যোগ্যতা ও দক্ষতা বিশ্লেষণপূর্বক তবেই কাহাকে রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। যাহারা সরাসরি জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হইবেন, তাহাদেরও বিশেষ যোগ্যতা লাগে। তাহার গাড়িটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিপতিত হওয়ার পরও সেই খবর সংশ্লিষ্ট থানায় প্রায় ৯ ঘণ্টার মধ্যেও কেন অবহিত করেন নাই, এমন অভিযোগ উঠিবার পর এডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নাই। অর্থাত্ অদায়িত্বশীল বা দায়িত্ব কর্মকাণ্ডহীন কেহ রাষ্ট্রীয় পদের জন্য উপযুক্ত নহেন। এমনকি মন্ত্রী হইবার পরও কাহারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম কিংবা অদক্ষতার অভিযোগ উঠিলে যুক্তরাজ্যের মতো দেশে তাহাকে মিনিস্ট্রারিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস বিভাগের মুখোমুখি হইতে হয়। এই ধরনের অভিযোগ উঠিবামাত্র তদন্তের স্বার্থে তাহাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিতে হয়।
অতএব, রাষ্ট্র বা দেশ পরিচালনা করা যে কঠিন কাজ তাহা আর বলিবার অপেক্ষা রাখে না; কিন্তু অন্যান্য পেশার মতো এই ক্ষেত্রেও কেন ক্যারিয়ার গঠনে বিশেষ যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনকে গুরুত্ব দেওয়া হইবে না? উন্নয়নশীল দেশগুলি যতদিন দেশ ও জাতির স্বার্থে দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং নীতি-নৈতিকতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ তৈরি করিতে না পারিবে, ততদিন সেই সকল দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না।