শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মিনিকেট চাউল: এই চালবাজি বন্ধ হউক

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৯

আমরা প্রতিদিন যে খাদ্য গ্রহণ করি, তাহার মূল উদ্দেশ্য হইল পুষ্টিচাহিদা মিটানো। চাউল এমন একটি খাদ্য, যাহা দ্বারা আমরা ক্যালরি, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিনসহ বিভিন্ন পুষ্টিগুণ লাভ করিয়া থাকি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আবহাওয়া ধান উত্পাদনের অধিক উপযোগী বলিয়া বিশ্বে শীর্ষ ১০ চাউল উত্পাদনকারী দেশ এই অঞ্চলেই অবস্থিত। একই কারণে ইহার অধিকাংশ দেশে ভাত প্রধান খাদ্য হিসাবে বিবেচিত। কিন্তু চাউলে যেই হারে ভেজাল সংমিশ্রণ করা হইতেছে, তাহাতে ইহার পুষ্টিগুণ লইয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে। বিশেষত আমাদের দেশে ইহার কারণে জনস্বাস্থ্য ক্রমেই ঝুঁকির মধ্যে পড়িতেছে।

গতকাল ইত্তেফাকের একটি খবরে বলা হইয়াছে যে, এই বত্সর মাহে রমজানে, বিশেষ করিয়া মিনিকেট চাউলের দাম বাড়িয়া গিয়াছে। এই চাউলের চাহিদা দেখিয়া আমরা বিস্মিত। কারণ, একে তো মিনিকেট নামে কোনো ধান নাই, এই চাউল সম্পূর্ণটাই কারসাজির ফসল। বিভিন্ন প্রকার মোটা চাউলকে মেশিনে কাটিয়া-ছাঁটিয়া চিকন করা হয়, যাহার ফলে ইহার পুষ্টিগুণ কমিয়া যায়। আর তুলনামূলকভাবে অপুষ্টিকর ও দামে চড়া এই চাউলের চাহিদা কীভাবে বাড়ে? ভোক্তাসাধারণের, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষিত মানুষের অসচেতনতাও এই জন্য বহুলাংশে দায়ী। তাহারই ফলে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট চাউলের দাম কেজিতে ৮ হইতে ১০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়া ৮৫ টাকা ছাড়িয়া গিয়াছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্যমতে, মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাতই নাই। তাই মিনিকেট নামে কোনো চাউলও থাকিতে পারে না। ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, ব্রি হাইব্রিড ধান ও কাজল লতার মতো মোটা জাতের ধান হইতে উত্পাদিত চাউল পলিশ করিয়া মিনিকেট নামে চালাইয়া দেওয়া হইতেছে। ইহার চাইতে বড় প্রতারণা আর কী হইতে পারে? চাউল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। ইহার দাম ভোক্তা ও ক্রেতা সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকুক, ইহাই কাম্য। একই সঙ্গে এমন একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় ও জরুরি পণ্যে যাহাতে কেহ কোনো প্রকার প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করিতে না পারে, সেই দিকেও নজর দিতে হইবে। ইতিমধ্যে মিনিকেট নামে কোনো চাউল বাজারজাত না করিতে ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের নির্দেশ দিয়াছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবে তাহার প্রতিফলন কোথায়? গত সোমবার খোদ খাদ্য মন্ত্রণালয়ও এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানাইয়াছে, মিনিকেট মূলত মেশিন প্রসেসড রাইস। তাহা হইলে এই নামে চাউলের ব্র্যান্ডিং কেন হইতেছে?

আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। কিন্তু দুঃখজনক হইলেও সত্য, এখন ধান উত্পাদনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া হইতে শুরু করিয়া রাইস মিলে চাউল প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন কীটনাশক ও ভেজাল মিশানো হইতেছে। চাউল অধিক আকর্ষণীয় করিতে কয়েক বার সিদ্ধ করা এবং বিভিন্নভাবে ছাঁটাই করিবার ফলে চাউলে থাকা ভিটামিন-বি নষ্ট হইয়া যায়। চাউলের রং আকর্ষণীয় করিতে রং মিশানো হইতেছে। চাউল সাদা করিতে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড দেওয়া হইতেছে। আবার চাউলের মধ্যে পুরাতন নষ্ট ময়দা ব্যবহার করিয়া সাদা করা হইতেছে। চাউলের মধ্যে ক্ষতিকর অ্যারারুট দেওয়া হইতেছে। চাউলের ওজন বাড়াইতে দেওয়া হইতেছে গুঁড়া পাথর, কাঁকর, ইটের গুঁড়া ইত্যাদি। কোনো শুভবুুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এইভাবে দেশ ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা করিতে পারে না। তাই এই ব্যাপারে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। কেননা ইহাতে ডায়রিয়া, বদহজম, ফুসফুস, কিডনি, লিভার ইত্যাদিসহ নানা অসুখের সৃষ্টি হয়। চকচক করিলেই যেমন সোনা হয় না, তেমনি চকচক করিলেই সেই চাউল পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ও উপকারী হইবে, তাহার কোনো মানে নাই। তাহা ছাড়া প্রবাদে আছে, আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী। তবে খাদ্যের ক্ষেত্রে এই কথা মোটেও চলে না। কেননা ইহার সহিত প্রাণ ধারণের বিষয় জড়িত। তাই চাউলসহ বিভিন্ন খাদ্যের ক্ষেত্রে চোখের গুরুত্বকে বেশি প্রাধান্য না দিয়া পুষ্টিগুণকে অগ্রাধিকার দিতে হইবে। এই ব্যাপারে আমরা যতই সচেতন হইব, ততই মঙ্গল।

ইত্তেফাক/টিএইচ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন