ইতিহাস মানবজাতির অতীতের এক লিখিত স্মারক; কিন্তু ইতিহাস কি সত্যের প্রতিচ্ছবি, নাকি কেবল বিজয়ীদের ভাষ্য? প্রাচীনকাল হইতে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বারংবার দেখা গিয়াছে যে, যাহাদের হাতে কলম, তাহারাই ইতিহাসকে আপন সুবিধামতো রচনা করিয়াছেন। পরাজিতদের কথা, তাহাদের বেদনা, তাহাদের যুক্তি—ইতিহাসে স্থান পায় না, বা যদি স্থান পায়ও, তাহা বিজয়ীদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই লেখা হয়। ইতিহাস বা কাহিনি কী করিয়া আমাদের মনোজগতে সত্য হিসাবে প্রতিভাত হয়, তাহার একটি প্রতীকী চিত্র আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতা হইতে অনুধাবন করিতে পারি। কবিতাটির সারাংশে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন যে, দেবর্ষি নারদের মহাকবি বাল্মীকিকে বলিলেন অযোধ্যার রঘুপতি রামের কীর্তি লইয়া রামায়ণ রচনা করিতে। ইহা শুনিয়া বাল্মীকি বলিলেন যে, তিনি রামের কীর্তি শুনিয়াছেন বটে; কিন্তু সমগ্র ঘটনা জানেন না এবং সত্যনিষ্ঠভাবে রামের কাহিনি রচনা করিতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। তখন নারদ বলিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’ বলিবার অপেক্ষা রাখে না, এই উক্তিটি শুধু সাহিত্যের নহে, ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও গূঢ় সত্য।
ইতিহাস যে কেবল ঘটনার বিবরণ নহে, ইহা এক নির্মাণ—এমন মতবাদ বহু ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক পোষণ করিয়াছেন। জর্জ ওরওয়েল তাহার বিখ্যাত গ্রন্থ ১৯৮৪-এ বলিয়াছেন, Who controls the past controls the future; who controls the present controls the past. অর্থাত্ যাহারা বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহারাই অতীতের ব্যাখ্যা নির্ধারণ করিতে পারেন এবং সেই ব্যাখ্যা ভবিষ্যত্ প্রজন্মের বিশ্বাস গঠনে ভূমিকা রাখে। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এক বিশেষ প্রবণতা লক্ষ করা যায়—যাহারা শক্তিশালী, তাহাদের গুণাবলি বর্ণনায় ইতিহাস মুখর, অথচ যাহারা পরাজিত, তাহাদের নীরবতা বা নেতিবাচক চিত্র ইতিহাসে স্থান পায়। পশ্চিমা ইতিহাসবিদ অ্যাডওয়ার্ড সাইদ ‘ওরিয়েনটালিজম’ গ্রন্থে দেখাইয়াছেন কীভাবে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলি ইতিহাসকে আপন স্বার্থে রচিত করিয়াছে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা নিজেদের সভ্য ও উন্নত প্রমাণ করিবার জন্য নেটিভ জাতিগুলিকে বর্বর ও অনগ্রসর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। বস্তুত, এই ইতিহাস একচোখা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইতিহাস রচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হইল বিজয়ীদের দ্বারা পরাজিতদের কাহিনির অপলাপ। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে রবেস্পিয়ের ও অন্যান্য বিপ্লবীর কার্যকলাপকে বর্বরতা বলিয়া দেখানো হইয়াছে, অথচ তাহাদের বিপ্লবী আদর্শ কীভাবে সাম্য ও ন্যায়ের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল, তাহা তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিেশ বলিয়াছেন, ‘There are no facts, only interpretations.’ অর্থাত্ ইতিহাস কেবল নির্দিষ্ট তথ্যের সমষ্টি নহে, ইহা ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে। বিজয়ীরা যেইভাবে ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন, তাহাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসাবে গৃহীত হয়। ইতিহাসের এই সকল দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে, যাহাদের হাতে লেখার ক্ষমতা রহিয়াছে, তাহারাই নিজেদের পছন্দের ইতিহাসকে ‘সত্য’ বলিয়া নিয়ন্ত্রণ করিতে পারেন।
ইতিহাসকে সত্যের নিকটবর্তী করিতে হইলে আমাদের একটি বহুস্তরীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিবার সময় আসিয়াছে। ইতিহাসকে ন্যায়বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া পরাজিতদের কণ্ঠস্বরকেও শুনিবার কথা বলিয়া থাকেন অনেক ইতিহাসবেত্তা। তাহা না হইলে, আমাদের কেবল বিজয়ীদের রচিত গল্পকেই ইতিহাস বলিয়া মানিয়া লইতে বাধ্য থাকিব। তাহাতে প্রকৃত সত্য চাপা পড়িয়া থাকিবে, কখনো কখনো তাহা চিরকালই অধরা থাকিয়া যাইতে পারে। তবে বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে, ইতিহাসকে পুনরায় বিশ্লেষণ করা সম্ভব হইতেছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে তথ্য সংগ্রহ করিয়া ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ রূপ উপস্থাপনের এক সুবর্ণ সুযোগ রহিয়াছে। সেই কারণে সাময়িকভাবে কোনো সত্যের বিকৃত ঘটনা সম্ভব হইলেও প্রযুক্তির কারণে ভবিষ্যতে তাহার সত্য উদ্ঘাটন দুরূহ কোনো বিষয় নহে। সুতরাং অতীতের মতো কোনো গল্পকে ইতিহাস হিসাবে চালাইয়া দেওয়া ভবিষ্যত্ পৃথিবীতে সম্ভব হইবে না বলিয়াই মনে করা হইতেছে।