মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ঈদে বাড়ি ফিরা ও বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা

আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১:৩৪

প্রতি বত্সর দুইটি ঈদ উত্সবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হঠাত্ করিয়াই ফাঁকা হইয়া যায়। সারা বত্সর ২ কোটি ৪০ লক্ষাধিক লোকের চাপে ক্লিষ্ট এই রাজধানীতে বসবাসকারীর মধ্যে এইবার প্রায় পৌনে ২ কোটি মানুষ ঢাকা ত্যাগ করিবেন বলিয়া ধারণা করা হইতেছে। অর্থাত্ প্রায় ৭৩ শতাংশ ঢাকাবাসী এই সময় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করিতে ‘দেশের বাড়ি’ ফিরিয়া যাইবেন। কয়েক দিন পর রুটি-রুজির তাগিদে আবার তাহারা ঢাকায় পাড়ি জমায়। ঢাকার রাস্তা আবার যানজট আর কোলাহলে ভরিয়া যায়। এত অল্প সময়ে এত বিশালসংখ্যক অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বিশ্বের খুব কম শহরেই দেখা যায়।

এই ঘটনা কেবল যাতায়াতের বিষয় নহে, বরং ইহা দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোর একটি বড় সমস্যার প্রতিবিম্ব তুলিয়া ধরে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, উন্নত চিকিত্সা—সকল কিছুর সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে মানুষ ঢাকায় ছুটিয়া আসে। ঢাকামুখী হইবার প্রবণতা অবশ্য পূর্বেও ছিল। তখন যাতায়াতের সময় মানুষের ভোগান্তি বেশি হইত, যাহা এখন অনেকটা কমিয়া আসিয়াছে। একসময় বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই অনুন্নত ছিল যে, বিবাহের সময় বরপক্ষ কনেপক্ষকে জিজ্ঞাসা করিত, ‘আপনাদের বাড়িতে যাইবার রাস্তা আছে তো?’ কিংবা, ‘বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি আছে তো?’ অনেক গ্রামে সন্ধ্যার পর আলো বলিতে ছিল কেবল কুপি বা হারিকেন, আর বর্ষাকালে বিয়ের বরযাত্রীদের কাদামাটি ভাঙিয়া হাঁটিয়া যাওয়া ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। আজকের বাংলাদেশ সেই জায়গা থেকে অনেক আগাইয়া আসিয়াছে। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুত্ পৌঁছাইয়া গিয়াছে, রাস্তা তৈরি হইয়াছে, পরিবহনব্যবস্থা উন্নত হইয়াছে।

তবে এখনো দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা মানুষকে সহজে ঢাকায় যাওয়া-আসা আরো বেশি সহজ করিয়া দিয়াছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি কাজে কেন ঢাকাতেই ছুটিয়া আসিতে হইবে? এই সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হইল ‘বিকেন্দ্রীকরণ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০ লক্ষ। পাঁচ দশকের ব্যবধানে তাহা বাড়িয়া দাঁড়াইয়াছে ২ কোটিতে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ এই একটি শহরে বাস করে। সুতরাং দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য তাই বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশ তাহাদের রাজধানীকেন্দ্রিক চাপ কমাইয়া অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করিয়াছে। চীনের অর্থনীতি একসময় বেইজিং ও সাংহাইয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেইখানে দেশ জুড়িয়া ৩০টিরও বেশি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করার ফলে কর্মসংস্থান ও শিল্প উত্পাদন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়াইয়া যায়। জার্মানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। দেশটির রাজধানী বার্লিন হইলেও অর্থনৈতিকভাবে মিউনিখ, ফ্রাংকফুর্ট, হামবুর্গের মতো শহরগুলি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কর্মসংস্থানের জন্য সবাই রাজধানীতে ছুটিতে বাধ্য হয় না। বাংলাদেশকেও যদি সঠিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, তাহা হইলে ঢাকার উপর চাপ কমিবে।

বিকেন্দ্রীকরণ সফল করিতে প্রথমেই প্রশাসনিক কার্যক্রম ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করিতে হইবে। বর্তমানে সরকারি অফিস ও মন্ত্রণালয়গুলির প্রায় সকল কার্যক্রম ঢাকায় হওয়ায় জনগণকে প্রায়ই রাজধানীতে আসিতে হয়। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। যদি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিশেষায়িত শিল্প এলাকা তৈরি করা হয় এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ঢাকার বাইরে বিনিয়োগে প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহা হইলে কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকায় মানুষের চাপ বহুলাংশে কমিয়া যাইবে।

ইহা ছাড়াও ঢাকার পাশাপাশি দেশব্যাপী উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। ১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ কাটাইয়া উঠিবার অন্যতম কৌশল ছিল ব্যাপক যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন। দেশ জুড়িয়া নূতন সড়ক, রেললাইন, ব্রিজ নির্মাণের ফলে পণ্য পরিবহন সহজ হইয়া গিয়াছিল। ইহার কারণে নূতন শহর গড়িয়া উঠে, কর্মসংস্থান বাড়ে এবং দেশটি দ্রুত অর্থনৈতিক সংকট কাটাইয়া উঠিতে সক্ষম হয়। সুতরাং বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে রাজধানীও বসবাস উপযুক্ত হইবে এবং সারা দেশের অন্যান্য অংশেরও গুরুত্ব বাড়িবে। আর এইখানেই বর্তমান কানেকটিভি অনেক অধিক সহায়ক।

ইত্তেফাক/এএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন