মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

স্বাধীনতাকে আরো অর্থবহ ও টিকসই করিতে হইবে

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ১০:০৩

আজ ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের অন্যতম নিয়ামক হইল সেই দেশের এই জাতীয় দিবস। প্রজাতন্ত্র দিবস, বিপ্লব দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবস—যেই নামেই অভিহিত হউক না কেন, জাতীয় দিবস একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া পরিচিতি প্রদান করে। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ব্যতীত পৃথিবীর সকল দেশেই কোনো না কোনো নামে জাতীয় দিবস উদ্‌যাপন করা হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালে হইলেও বাংলা জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব বহুকাল পূর্বের। বিশেষ করিয়া, বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে মুক্ত করিবার যে লড়াই এই অঞ্চলের মানুষের দ্বারা সংঘটিত হইয়াছিল তাহার সূচনাটা ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে নিহিত ছিল; কিন্তু লাহোর প্রস্তাবকে উপেক্ষা করিয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শোষণ ও নিষ্পেষণের মাধ্যমে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন করিবার যে দুরভিসন্ধি, তাহা আমাদের জাতি রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করে।

আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হইয়াছে ১৯৭১ সালের ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়া। এই জন্য আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস যেমন গৌরবের, তেমনি বেদনারও। সেই সশস্ত্র সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত্রি তথা ২৬ মার্চের আজিকার দিনে। তাই এই দিনটি আমাদের মনে করাইয়া দেয় একাত্তরের বজ্রকঠিন সংগ্রাম ও হিরণ্ময় বিজয়ের কথা। তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাহাদের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তস্নাত সংগ্রাম শুরুর মধ্য দিয়া শত শত বত্সরের আকাঙ্ক্ষা পূরণে অগ্রসর হয় এই ভূখণ্ডের বঞ্চিত ও শোষিত গণমানুষ। একাত্তরে রেসকোর্স ময়দানের ৭ মার্চের বিশাল ঐতিহাসিক জনসভায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত্রিতে গণহত্যার সূত্র ধরিয়া এই জাতি দীপ্ত প্রত্যয়ে ঝাঁপাইয়া পড়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনাইয়া আনে।

অতঃপর স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি সাধন করিয়াছে। দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, বিভিন্ন অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন ঘটিয়াছে। বিশেষ করিয়া রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট প্রভৃতি উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি লক্ষণীয়; কিন্তু রাজনীতি, কূটনীতিসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করিতে পারি নাই। যদিও এই পর্যন্ত যত সাফল্য অর্জিত হইয়াছে, তাহার পশ্চাতে রাজনৈতিক নেতাদের অবদানই অধিক; কিন্তু জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক উন্নয়ন, বৈষম্য নিরসন, তরুণসমাজের স্বপ্ন পূরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা সীমাহীন। যেই কারণে আমাদের যেই অবস্থানে থাকিবার কথা ছিল, আমরা সেইখানে পৌঁছাইতে পারি নাই। কেননা আমাদের পরে স্বাধীনতা লাভ করিয়া এশিয়ারই অনেক দেশ উন্নতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদেরকে বহু আগেই ছাড়াইয়া গিয়াছে।

একাত্তরে যে চেতনায় উজ্জীবিত হইয়া এই দেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অমিত বিক্রমে ঝাঁপাইয়া পড়েন, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসের মধ্য দিয়া সেই সংগ্রামী চেতনা বর্তমান প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত ও শানিত করিতেছে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। সম্প্রতি আমাদের নূতন প্রজন্ম যেইভাবে জীবন বাজি রাখিয়া মানুষের গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার নজির স্থাপন করিয়াছেন, তাহাও অবিস্মরণীয় ও অনুপেক্ষণীয়। তবে বারংবার যাহাতে মানুষের ত্যাগ ও সংগ্রামের ফসল হাতছাড়া না হয়, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এই স্বাধীনতাকে আরো অর্থবহ করিতে হইলে প্রয়োজন স্বাধীনতা রক্ষার নিরন্তর সংগ্রাম ও নূতন দীপ্ত অঙ্গীকার। এই জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করিবার মাধ্যমে ইহাকে টিকসই রূপ প্রদান করা।

আজিকার এই মহান দিনে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধের সকল শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আহত-নির্যাতিতের গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করি। শ্রদ্ধা জানাই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সকল সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। পরিশেষে সকলের প্রতি রহিল স্বাধীনতা দিবসের সংগ্রামী সালাম ও অনাবিল শুভেচ্ছা। 

ইত্তেফাক/এএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন