মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধের অবদান

আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ২০:২০

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিকরা। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, তখন ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা পুরো জাতিকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য করে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংস হামলার বিপরীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দেশপ্রেমিক সৈনিকরা অসীম সাহসিকতায় বিদ্রোহ করে এবং সুসংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

অস্ত্র ও রসদের সংকট থাকা সত্ত্বেও তারা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, যা পরবর্তী সময় সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। এই প্রতিরোধ কেবল সামরিক লড়াই ছিল না; এটি ছিল এক অবিনাশী চেতনার প্রকাশ, যা পরবর্তী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে জাতিকে পৌঁছে দেয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধ: ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় দমন-পীড়ন চালায়। তবে ২৫ মার্চ রাতে 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে পরিচালিত গণহত্যা সমগ্র দেশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ২৫ মার্চ রাতে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে হামলা চালিয়ে প্রায় ২ হাজার ৫০০ বাঙালি প্রশিক্ষণার্থী সৈনিককে নির্মমভাবে হত্যা করে। কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসেও হয়েছিল ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। ২৫ মার্চ রাতে ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন ইউনিটে থাকা বাঙালি সৈনিকদের বেশির ভাগই হত্যার শিকার হন।

এই গণহত্যা শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম বা কুমিল্লায় নয়, সারা দেশেই চলছিল। যার ফলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) দেশপ্রেমিক সৈনিকরা সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিলে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাঙালি ইউনিটগুলোকে সেনানিবাস থেকে দূরে পাঠিয়ে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলেও ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ তাদের প্রতিরোধ গড়তে বাধ্য করে। চট্টগ্রামে ৮ ইস্ট বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল, যশোরে ১ ও ময়মনসিংহে ২ ইস্ট বেঙ্গল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই প্রতিরোধই মহান স্বাধীনতার পথে প্রথম দৃঢ় পদক্ষেপ ছিল।

১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ: ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা 'সিনিয়র টাইগার্স' নামে পরিচিত, ১৯৭১ সালের মার্চে যশোর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। পাকিস্তান সরকার পূর্বপরিকল্পিতভাবে ইউনিটের একটি অংশকে শিয়ালকোটে বদলি করে এবং অন্যদের প্রশিক্ষণের নামে দূরে পাঠায়। ২৯ মার্চ রাতে ব্যাটালিয়নটি যশোর সেনানিবাসে ফিরে এলে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখে সতর্ক হয়। ৩০ মার্চ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। টানা সাত ঘণ্টার লড়াইয়ের পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে চৌগাছার দিকে অগ্রসর হয়। গভীর রাতে মাসালিয়ায় ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে প্রায় ২০০ সৈনিক পুনরায় সংগঠিত হয়। এখানে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও সাধারণ জনগণ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৪ এপ্রিল তারা কাগজপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়।

২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ: ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা 'জুনিয়র টাইগার্স' নামে পরিচিত, ৫৭ ব্রিগেডের অধীনে জয়দেবপুরে অবস্থান করছিল। ২৮ মার্চ মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকরা সেনানিবাস ত্যাগ করে এবং ২৯ মার্চ ময়মনসিংহে পৌঁছে পুলিশ, ইপিআর ও সাধারণ জনগণকে নিয়ে প্রায় ৩ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী গঠন করে। ২ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা ভৈরবের দিকে অগ্রসর হলে ২ ইস্ট বেঙ্গল ও ইপিআরের সৈন্যরা নরসিংদীতে অ্যাম্বুশ করে। এতে পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়। পরবর্তীকালে, মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদ মোশাররফ তেলিয়াপাড়ায় মিলিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন।

৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ: ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যা 'মাইনর টাইগার্স' নামে পরিচিত, সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। পাকিস্তান সেনারা মার্চের শুরু থেকেই ইউনিটটিকে দুর্বল করার কৌশল নেয়। ২৫ মার্চ ভোরে ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স সৈয়দপুরে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঘিরে ফেলে। ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন এবং ২৬ ও ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ে ইপিআরের সঙ্গে যোগ দেন। ২৮ মার্চ পলাশবাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অ্যাম্বুশ পরিচালনা করা হয়। ৩০ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করলে ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও সুবেদার মেজর হারিসের নেতৃত্বে প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ৪ এপ্রিল পার্বতীপুর পুনর্দখল করা হয় এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট খোলাহাটিতে প্রতিরক্ষাঘাঁটি স্থাপন করে।

৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ: ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। ১৮ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার পরিকল্পনার কথা জানার পর ক্যাপ্টেন গাফ্ফারের নির্দেশে সৈন্যরা অস্ত্র বের করে প্রস্তুতি নেয়। ২৬ মার্চ ঢাকার গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে মেজর শাফায়াত জামিল ও মেজর খালেদ বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। ২৭ মার্চ মেজর শাফায়াত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানি অফিসারদের বন্দি করেন এবং ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা ও সিলেট পর্যন্ত এলাকা মুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়।

৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ: ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। মার্চের প্রথম থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অস্ত্র জমা দিতে বাধ্য করে ও সৈন্যদের ছুটিতে পাঠায়। ১৭ মার্চ এক গোপন বৈঠকে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ২৫ মার্চ ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন ক্যাপ্টেন অলি আহমেদকে সতর্ক করেন। মেজর জিয়া বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন এবং ২৬ মার্চ সকালে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কালুরঘাটে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৌ ও বিমান হামলা চালিয়ে কালুরঘাট ধ্বংস করলে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রাঙামাটির দিকে সরে যায়।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা: ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সাধারণ জনগণের মনোবলকে উজ্জীবিত করে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে তাদের অনুপ্রাণিত করে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সাহসী বাঙালি সেনারা অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্বল্পতা সত্ত্বেও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সাধারণ জনগণ এবং অন্যান্য সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ প্রমাণ করে যে, সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব।

চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে গঠিত প্রতিরোধে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়, যা সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেয়। যশোর, কুমিল্লা, সৈয়দপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ভিত তৈরি করে। এই প্রাথমিক প্রতিরোধই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবিশ্বাস জোগায়, যা দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করে। এই প্রতিরোধ সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তোলে এবং তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে অনুপ্রাণিত করে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ত্যাগই দেশব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।

স্বাধীনতাসংগ্রামে গণজাগরণ সৃষ্টি: স্বাধীনতাসংগ্রামে গণজাগরণ সৃষ্টিতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধ ছিল ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের এই প্রতিরোধ শুধু সামরিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং এটি সাধারণ জনগণের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। তাদের সাহসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ জনগণও প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা পরে সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। বলা যায়, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ শুধু সামরিক প্রতিরোধই ছিল না, বরং এটি পুরো জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তীব্রতর করে তোলে এবং গণজাগরণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে আরো সুসংগঠিত করে।

মুক্তিবাহিনীর গঠন ও ছাত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধের ভূমিকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সূচনা। এই প্রাথমিক প্রতিরোধই পরবর্তীকালে মুক্তিবাহিনী গঠনের ভিত্তি স্থাপন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর দমননীতি থেকে বাঁচতে এবং সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হাজারো তরুণ, বিশেষ করে ছাত্ররা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সেনারা ছাত্র-জনতাকে সামরিক প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণশিবিরে ছাত্র-জনতাকে গেরিলা যুদ্ধ, অস্ত্র চালনা, কৌশলগত আক্রমণ এবং আরক্ষার কৌশল শেখায়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পরিচালনা করা হয়।

এই প্রশিক্ষণের ফলে ছাত্র-যুবকদের গেরিলা যুদ্ধের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের সহযোগিতায় প্রশিক্ষিত এই ছাত্র-যুবকরাই বিভিন্ন সেক্টরে বীরত্বপূর্ণ লড়াই চালিয়ে যান। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অভিজ্ঞ বীর সেনারা তাদের সামরিক জ্ঞান ও যুদ্ধকৌশল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে অনন্য ভূমিকা রাখে, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং ১১টি সেক্টর গঠনে ভূমিকা রাখেন। তাদের নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত বাহিনী গঠিত হয়, যা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সুসংগঠিত প্রতিরোধ নিশ্চিত করে। এই প্রতিরোধ পাকিস্তানি বাহিনীর সহজ বিজয়ের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি করে, যা মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কাঠামোকে আরো সুসংহত করে। এটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক সক্ষমতার গুরুত্ব তুলে ধরে। ফলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধ কেবল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধই নয়, বরং এটি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষিত বাহিনী তৈরি করা এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি মজবুত ভিত্তি স্থাপন করে, যা চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে সহায়ক হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে গঠিত প্রতিরোধযুদ্ধ শুধু সামরিক পরিকল্পনার ভিত্তি গড়ে তোলে না, বরং এটি রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে আরো সুস্পষ্ট করে তোলে। তাদের প্রতিরোধের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং স্বাধীনতা অর্জনই একমাত্র বিকল্প।

পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল দুর্বলকরণ: পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল দুর্বল করতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধ ছিল এক কৌশলগত ও মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। চট্টগ্রাম, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, যা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল। বিশেষ করে যশোরে ১ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও চট্টগ্রামের ৮ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তীব্র প্রতিরোধ শত্রু বাহিনীর মধ্যে ভয় সৃষ্টি করে এবং তাদের দ্রুত অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে। এ প্রতিরোধ কেবল পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক পরিকল্পনাকে ব্যাহত করেনি, বরং তাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা বুঝতে পারে যে, তারা শুধু নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না, বরং সুসংগঠিত ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীও তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এতে তাদের নিজেদের সেনাবাহিনীর মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং মনোবল ভেঙে পড়ে। প্রতিরোধের ফলেই পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিত দখলদারিত্ব সহজে কায়েম করতে ব্যর্থ হয় এবং স্বাধীনতার লড়াই আরো সুসংগঠিত রূপ নেয়। সুতরাং, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধ কেবল সামরিকভাবে নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও পাকিস্তানি সেনাদের দুর্বল করে ফেলে।

উপসংহার: ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রাথমিক প্রতিরোধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যা পাকিস্তানি বাহিনীর সহজ বিজয়ের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয় এবং পুরো জাতিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করে। এই প্রতিরোধ শুধু সামরিকভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবল দুর্বল করেনি, বরং এটি সাধারণ জনগণ, ছাত্র ও যুবকদের সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সেনাদের সাহস, দেশপ্রেম ও ত্যাগ মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে তোলে এবং বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের প্রতিরোধ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি সমর্থন আদায়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আজও, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আত্মত্যাগ ও বীরত্ব জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গৌরবের সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছে, যা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেম ও ত্যাগের শিক্ষা দিয়ে চলেছে।

লেখক: সেনা কর্মকর্তা

ইত্তেফাক/এসএএস