বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মিয়ানমারের বিধ্বংসী ভূমিকম্প, আমরা শোকাহত 

আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:০০

ভূমিকম্প এই বিশ্বের সবচাইতে বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলির মধ্যে একটি, যাহা কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই যেই কোনো মুহূর্তে আঘাত হানিতে পারে। ইহা মূলত পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে ঘটে। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভূত্বক কয়েকটি ছোট ও বড় স্তর দ্বারা গঠিত। এই স্তরগুলির আকস্মিক ও অস্বাভাবিক নড়াচড়ার ফলে ভূত্বকের উপরিভাগে একধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়, যাহাকে আমরা ভূমিকম্প বলি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়াইয়া কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের মহাকাশ পর্যবেক্ষণের প্রযুক্তি আমাদের থাকিলেও, আমাদের নিজ গ্রহের অভ্যন্তরীণ স্তরগুলির গতিবিধি নিরীক্ষণের প্রযুক্তি আমরা এখনো সফলভাবে আবিষ্কার করিতে পারি নাই। তাই অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই কারণেই পৃথিবীর অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে অধিক ভয়াবহ। তবে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অঞ্চলের ভূত্বকের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করিয়া ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল নির্ধারণ করিতে সক্ষম হইয়াছেন। জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, তুরস্ক, চীন প্রভৃতি দেশ ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ায় সেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্প হইবার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি।

গতকাল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের নিকট ৭.৭ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানিয়াছে। শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের ফলে শহরের একাধিক বহুতল ভবন ধসিয়া পড়িয়াছে, রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হইয়াছে, হতাহত হইয়াছে অসংখ্য মানুষ। প্রথম ভূমিকম্পের ১২ মিনিট পর ৬.৪ মাত্রার আরেকটি পরাঘাত (আফটারশক) অনুভূত হয়, যাহার কেন্দ্রস্থল সাগাইং থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে। এই ভূমিকম্পের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, মান্দালয় হইতে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরের থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বহুতল ভবনগুলিও কাঁপিয়া ওঠে। ভূমিকম্পের ফলে ব্যাংকক স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনও সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।

মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এই দুর্যোগ মোকাবিলাকে আরো কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির সরকার ও প্রশাসন অস্থিতিশীল অবস্থায় রহিয়াছে। ভূমিকম্পের কারণে দেশটির সামরিক সরকার ইতিমধ্যে একাধিক অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করিয়াছে। তবে সরকারের কঠোর সেন্সরশিপের কারণে এখন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয় নাই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলি আশঙ্কা করিতেছে, হতাহতের সংখ্যা হাজার ছাড়াইয়া যাইতে পারে। মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, যাহার ফলে ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকার্য ও চিকিৎসা সহায়তা ব্যাহত হইতেছে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরবরাহ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করাও চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ৭.৮ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে, যেইখানে ৫০ হাজারেরও অধিক মানুষ নিহত এবং লক্ষাধিক মানুষ আহত হয়। সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর বিশ্বের নানা প্রান্ত হইতে সহায়তার হাত বাড়ানো হইয়াছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা আহ্বান জানাই, তাহারা যেন অনুরূপভাবে মিয়ানমারের বিপর্যস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ায় এবং যথাযথ সহায়তা প্রদান করে। আমরা জানি, ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যাহা পৃথিবীর গতিশীল প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তবে, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, অবকাঠামোগত পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। আমরা আশা করি, বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে অদূর ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হইবে এবং জানমালের ক্ষতি বহুলাংশে হ্রাস পাইবে।

ইত্তেফাক/এএম