এ জেগে উঠি, দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা প্রতিদিন এক অজানা আতঙে ঘুম থেকে কখন বিঘ্ন হয়, কে জানে। চেষ্টা করি সব চিন্তার কালো দূর করতে, কিন্তু আবারও তা ঘিরে ধরে। কেন এমন হচ্ছে? গত বছর ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে জনমনে যে আনন্দ বিকশিত হয়েছিল, কিছু মাসের দূরত্বেই সেই স্থানন্দানুভুতি অনেকটাই উবে গেছে। সেখানে নানা দুর্ভাবনা এবং তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে ক্রমাগতভাবে সেনাবাহিনীকে হেয়া করার আত্মঘাতী প্রবণতা।
কিন্তু কেন এসব হচ্ছে এবং করা করছে? দেখাই যাচ্ছে, এসব করছে দেশে নতুন করে গজানো কাঁচা লতার মতো রাজনৈতিক দলের তথাকথিত নেতা। এসব করছে তাদের গুরু ইউটিউবে টাকা কামানো এবং মহা বিলাসে বিদেশে বসবাস করা অপরাধী মানসিকতাসম্পন্ন লোক। চেহারাগুলো সবার চেনা। তাদের ভাবটা হলো, তারা মস্ত নেতা। দেশের জনগণ তাদের কথায় ওঠে আর বসে। নিজের অহংকারে তার এতটাই অবরুদ্ধ যে, নিজের দুর্বল হাত-পা নিজের চোখেই পড়ে না। তারা ভুলেই যায়, সশস্ত্র বাহিনী একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ।
কিন্তু দেশের মানুষ জানে, দেশের ভূখণ্ডের নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে একটি দক্ষ, একতাবদ্ধ ও মনোবলসম্পন্ন সশস্ত্র বাহিনীর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই ভূমিকা অত্যন্ত পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজনীতি করতে আসা কিছু মানুষের অসুস্থ মানসিকতার কদর্য বহিঃপ্রকাশও ঘটছে। নিঃসন্দেহে এসব প্রচেষ্টা সেনাবাহিনীর প্রতি জনআস্থা বিনষ্ট করতে কালো ছায়া ফেলতে চায়। স্পষ্টই মনে হয়, তাদের এসব কথাবার্তা নিছক সমালোচনা নয়, বরং বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ।
ইতিহাস জানে, যেসব রাষ্ট্র তাদের সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা অচিরেই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় ডুবে অভ্যন্তরীণ স্তরে ক্ষতির মুখে বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এমন ধারার কিছু অস্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবু একটি মহল সুনির্দিষ্টভাবে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে অপমান করে পুরো বাহিনীকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে জিদ ধরেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিছু রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম থেকে সেনা প্রধানকে উদ্দেশ করে নোংরা ও বিভ্রান্তিকর ভাষা প্রয়োগ করেই যাচ্ছে তারা। কয়েক জন তো অসীম ধৃষ্টতায় হুমকি দিয়ে বলছে, ক্যান্টনমেন্ট উড়িয়ে দেব। সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিতে প্রস্তুত। তাদের এসব হুংকার সুস্পষ্ট দেশদ্রোহ। তাদের ভাষায় স্পষ্ট, তারা সেনাবাহিনীর কাঠামো এবং মনোবল ভাঙার হীন প্রয়াসে লিপ্ত। তারা দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলছে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ধরনের যড়যন্ত্র কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন বা একক ব্যক্তির অভিপ্রায় নয়; বরং এটির পেছনে দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সমন্বিত প্রয়াস রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ যে ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত, তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি কৌশলগত স্পর্শকাতর এলাকা। প্রসঙ্গত, অবসরে যাওয়ার আগে আমি বঙ্গোপসাগরঘেঁষা সাত জাতি রাষ্ট্র মিলে অর্থনৈতিক ও টেকনিক্যাল উন্নয়নের অঞ্চলিক সংস্থা বিমসটেকের সদর দপ্তরে উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলাম। উন্নয়ন স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নের সময় বুঝবার পূর্ণ সুযোগ পেয়েছি এই অঞ্চলটির নিরাপত্তার ধরনগুলো কতখানি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বলি, এ অঞ্চলের রাজনৈতিক এবং সামরিক অস্থিরতা যে কোনো সময় একটি বিস্তৃত সংকটে রূপ নিতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার যে কোনো প্রয়াস সরাসরি আমাদের দেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলার শামিল।
এই বাস্তবতায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চল কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টের একটি প্রতিবেদন জানায়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই মিয়ানমারে যুদ্ধ করতে, এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও 'প্রস্তুত'। তারা এখন নিজেদের 'স্বাধীনতাসংগ্রামী' হিসেবে দাবি করছে।
এই পরিস্থিতিকে কখনোই সরলরৈখিকভাবে দেখার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা ইস্যু এতদিন পর্যন্ত ছিল মানবিক সংকটের সীমায়। কিন্তু বর্তমানে এদের একটি অংশের অস্ত্রধারী মিলিশিয়ায় রূপান্তরের কারণে মিয়ানমার নয়, বাংলাদেশও জটিল প্রকৃতির নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। মূলত এদের অনুপ্রবেশ, অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র পরিবহন, সীমান্ত পারাপার এবং ক্যাম্পের ভেতরে রাজনৈতিক-সামরিক সংগঠনের বিকাশ বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্রের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুধু কি রোহিঙ্গারা এমন হুমকির জন্ম দৃশ্যমান? এর সঙ্গে খাড়ের ওপর বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গড়ে ওঠা বিদ্রোহী গোষ্ঠী 'আরাকান আর্মি'। তারা এখন এক ভয়ংকর সামরিক শক্তিতে পরিনত। ইতিমধ্যে ৩০ হাজারে বেশি নিয়মিত যোদ্ধার একটি সংগঠিত বাহিনী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশের নাফ নদীর তীর ঘেঁষে আরাকান আর্মির শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধির যুগল চিত্র বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ক্রমে এক জটিল নিরাপত্তা সংকটের জন্ম দিচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, এমন যদি হয় যে, এই দুই শক্তির মধ্যে যোগসূত্র গড়ে ওঠে, তাহলে এ কেবল সীমান্ত অঞ্চলে নয়, বরং বাংলাদেশের পুরো নিরাপত্তাকেই তছনছ করতে পারে।
আসলে যে কোনো নিরিখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার চেষ্টা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়াযায় না। বাংলাদেশকে রক্ষায় এই একটি প্রতিষ্ঠান এখনো সুসংহত এবং পেশাদারি মনোভাবে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছে। কিন্তু যারা সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চক্রান্তের জাল বুনছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে করা অপপ্রচার শুধু একটি প্রতিষ্ঠানকে নয়, পুরো রাষ্ট্রকাঠামোকেই দুর্বল করার ষড়যন্ত্র। আমাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, এটি একটি সংগঠন। সেনাপ্রধান বা অন্য কোনো কর্মকর্তার ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ করা মানে পুরো বাহিনীর মনোবলে আঘাত হানা। অথচ সবাই জানি, সেনাবাহিনী তার চেইন অব কমান্ড, একতা এবং শৃঙ্খলার জন্য পরিচিত। বাহিনীর কোনো অংশকে আলাদা করে বিবেচনা করা অসম্ভব, পুরো মূর্খতা।
সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেওয়ার হুংকার দেশ ও জনগণকে বিপন্ন করার ডাক। এমন পরিস্থিতিতে, দেশের সাধারণ জনগণ, রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমকর্মীদের একযোগে দায়িত্বশীল হতে হবে। সবার চিন্তা করা প্রয়োজন, কীভাবে এই রাষ্ট্রকে বিদেশি ষড়যন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কোনো বাহিনী তখনই দুর্বল হয়, যখন তার পেছনে জনসমর্থন থাকে না। সেই সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই। যারা হীন স্বার্থে সেনাবাহিনীর ঐক্যে আঘাত করতে প্রতিদিন কাজ করছে, তাদের জানা দরকার দেশ সুরক্ষায় সৈনিকের অস্ত্র কেবল সীমান্তের শূন্যরেখায় শত্রুর দিকে তাক করা থাকে না, প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা করতে জানে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীর ঐক্যের ছায়াতলে সবাই একত্রিত হলে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাশিল্পী