বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

এমন হৃদয়বিদারক মৃত্যু আর কাম্য নহে

আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২০

ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের মরিচালি গ্রাম। এই গ্রামে এখন চলিতেছে মাতম। থামিতেছে না এই গ্রামের ফিরোজা খাতুনের আহাজারি। আহাজারি করিতে করিতেই তিনি মূর্ছা যাইতেছেন। জ্ঞান ফিরিলেই বলিতেছেন : ‘আমার তো সবই শেষ।... বাবারে, কই গিয়া তুমি মরলা, সাত সমুদ্র ১৩ নদী পার অইয়া আমি কিবায় যাইয়াম?'
ফিরোজা খাতুন ইয়াসিন মিয়া শেখের (২২) মা। টগবগে এই যুবক ৪০ শতক জমি বিক্রয় করিয়া বহু কষ্টে ও প্রত্যাশায় গিয়াছিল রাশিয়া। এই জন্য তাহার ব্যয় হইয়াছিল ১৫ লক্ষ টাকা। প্রথমে তিন মাস রাশিয়ায় একটি চায়না কোম্পানিতে চাকুরি করেন। ইহার পর অনলাইনে আবেদন করিয়া রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক সৈনিক হিসাবে যোগ দেন। ইহার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেন এবং ঈদুল ফিতরের পূর্বে গত ২৭ মার্চ তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। বাংলাদেশে এই খবর আসে ঈদের পর। ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাহার শরীর ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। তাহার লাশ পাইবার আশা বলিতে গেলে নাই বলিলেই চলে।

বিশ্বে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অন্য দেশের নাগরিকদের ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসাবে ব্যবহারের নজির নতুন নহে। ইউক্রেন যুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসাবে যুদ্ধ করিবার কথা বিশ্বে বহুল আলোচিত। সাম্প্রতিক কালে সিরিয়া ও লিবিয়া যুদ্ধে এই রূপ বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়াছে। তাহা ছাড়া আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন গৃহযুদ্ধকবলিত দেশে মার্সেনারি ফোর্স বা ভাড়াটিয়া সৈন্যের ব্যবহার যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই জন্য গড়িয়া উঠিয়াছে বিভিন্ন প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি। অনেকে না জানিয়া তাহাদের ফাঁদে পা দিতেছে। অথচ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী মার্সেনারি ফোর্সেস বা ভাড়াটিয়া সৈন্য জাতিসংঘ দ্বারা নিষিদ্ধ; কিন্তু এই ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কার্যকরী নজরদারি নাই। অবশ্য আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় তাহা নহে। মূল বক্তব্য হইল নিহত ইয়াসিনেরই একটি ফেসবুক উক্তি। তিনি মারা যাইবার পূর্বে আক্ষেপ করিয়া লিখিয়াছেন যে, তিনি দেশে থাকিয়া সৈনিক হইতে পারেন নাই। তবে রাশিয়ায় তাহা ঠিকই করিয়া দেখাইয়াছেন। তাহার এই উক্তির মধ্যে হাজার হাজার বিদেশগামী বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীর স্বপ্নভঙ্গ ও তাহাদের বুক জুড়িয়া থাকা গভীর কষ্টের কথার প্রতিফলন ঘটিয়াছে। এই দেশে বহু কাঠখড় পুড়াইয়া লেখাপড়া করিলেও কাঙ্ক্ষিত চাকুরি না পাইয়া অবশেষে ভিটামাটি বিক্রয় করিয়া তাহাদের বিদেশ যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সেইখানে যাইতে গিয়া কত তাজা প্রাণ তরুণ যে মানবপাচারকারীর খপ্পরে পড়েন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়া ইউরোপে যাইতে কতজন যে সলিলসমাধির শিকার হন, তাহার ইয়ত্তা নাই। খোদ জাতিসংঘ এক রিপোর্টে বলিতেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়া ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে রহিয়াছে বাংলাদেশ, যাহা ২১ শতাংশ। আর যাহারা এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে মারা যাইতেছেন, তাহাদের ১২ শতাংশই বাংলাদেশি!
আমরা জানি, তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ। অথচ সেই সকল তরুণের স্বপ্ন পূরণের বাংলাদেশ আমরা এতদিনেও বানাইতে পারি নাই! জুলাই আন্দোলনের যেই সকল তরুণ-তরুণী রাজপথে নামিয়া আসিয়াছিল, তাহাদের প্রধান দাবিই ছিল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং চাকুরিতে বৈষম্য দূর করা; কিন্তু এখন তরুণদের সেই স্বপ্ন পূরণে তোড়জোড় কোথায়? কোথায় সেই মহাপরিকল্পনা ও রোড ম্যাপ? তরুণসমাজ বারংবার রক্ত দিবে আর তাহাদের শিক্ষা-কর্মসংস্থানসহ মৌলিক দাবি পূরণ হইবে না, তাহা কী করিয়া সম্ভব?

এই মুহূর্তে সরকারের উচিত, ইয়াসিনের পরিবার যাহাতে ক্ষতিপূরণ পায়, তাহার ব্যবস্থা করা। তবে আমাদের কামনা, ইয়াসিনের মতো আর কেহ যাহাতে এইভাবে বাধ্য হইয়া ভুল পথে পা না বাড়ায়। আমাদের তরুণরা যাহাতে নিজের দেশের জন্য লড়াই করে, অন্য দেশের পক্ষে নহে। উল্লেখ্য, ইহার পূর্বে দালালের খপ্পরে পড়িয়া রাশিয়ায় গিয়া ‘ভাড়াটে সৈনিক' হিসাবে ইউক্রেন যুদ্ধে এই বৎসরের ফেব্রুয়ারিতে প্রাণ হারান নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের যুবক মো. হুমায়ূন কবির। এই মৃত্যুও ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। অতএব, যেই সকল দেশ বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহার করিতেছে, সেই সকল দেশে আমাদের তরুণদের অভিবাসনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা আজ জরুরি হইয়া পড়িয়াছে। এই জন্য বিদেশে অবস্থিত আমাদের দূতাবাসগুলিতে এই ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা জারি করিতে হইবে।

ইত্তেফাক/এনএন