কুমিল্লা সদরের তরুণ আলী রেজা হায়দারের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে। কিন্তু ২০০২ সালে এইচএসসি পরীক্ষার পর তার জীবনে নেমে আসে এক বড় ধাক্কা। ফলাফল এতটাই খারাপ হয় যে, কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের ভর্তি তো দূর, ভর্তি পরীক্ষায় বসার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেননি।
২০০৫ সালে ঢাকায় এসে তিনি ভর্তি হন একটি পেছনের সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ২০০৮ সালে স্নাতক সম্পন্ন করলেও চাকরির বাজারে কোনো ভালো সুযোগ পাচ্ছিলেন না। হতাশ হয়ে ফিরে যান নিজ শহর কুমিল্লায়।
২০০৯ সালে জীবনের প্রথম চাকরি শুরু করেন এক আত্মীয়ের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে রিসেপশনিস্ট হিসেবে, মাত্র ছয় হাজার টাকা বেতনে। তবে কাজের পরিবেশ ও অন্যান্য সমস্যার কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই সেই চাকরি ছেড়ে দেন। এই ঘটনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন—নিজেই কিছু একটা করবেন।
এরপর পরিবারের আপত্তি উপেক্ষা করেই কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে কুমিল্লার গোমতীর পাড়ে শুরু করেন পরীক্ষামূলক স্ট্রবেরি চাষ। ধার করা ২০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। গাছের রোগে পুরো প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়ে যায়, আর তাদের ৫০,০০০ টাকারও বেশি বিনিয়োগ পানিতে চলে যায়। এই ব্যর্থতা ছিল তার জীবনের অন্যতম বড় ধাক্কা। কিছুদিন যাওয়ার পর ফুফাতো বোনের অনুরোধে ২০১০ সালে বিসিএস কোচিংয়ের সেমিনারে অংশ নেন আলী রেজা হায়দার। সেমিনারে অংশ নিয়ে বিসিএসের ব্যাপারে আগ্রহী হন তিনি। এরপর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। ৩০তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রথমবারই প্রিলিতে উত্তীর্ণ হন, যা তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। পরবর্তী ধাপে রিটেন পরীক্ষায়ও সফল হন, কিন্তু ভাইভা সন্তোষজনক না হওয়ায় নন-ক্যাডারে স্থান পান।
২০১১ সালে ৩১তম বিসিএসের জন্য আবার প্রস্তুতি নেন। এবারও প্রিলিতে উত্তীর্ণ হন এবং রিটেন পরীক্ষায় ভালো ফল করেন। পাশাপাশি, ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষাগুলোতেও অংশগ্রহণ করতে থাকেন।
২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ এমবিএ'র ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই, কিন্তু সেখানেও সুযোগ পেয়ে যান। তবে ক্লাস শুরুর কিছুদিন পরেই জনতা ব্যাংকের চাকরির সুযোগ আসে এবং চট্টগ্রামের কালুরঘাট শাখায় যোগদান করেন।
একই সময়ে ৩৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন, তবে রিটেন পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ৩১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়। নিজের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে তিনি কাস্টমস ক্যাডারে মেধাক্রমে ১১তম স্থান অধিকার করেন। এটি ছিল তার জীবনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। অক্টোবরে জনতা ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেন এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কাস্টমসে সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন আলী রেজা হায়দার।
আলী রেজা হায়দার বর্তমানে ঢাকা কাস্টমস হাউজে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে কর্মরত। বিচার শাখায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে বিমানবন্দরে আটককৃত পণ্যের দ্রুত নিষ্পত্তি করে সরকারি রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি যাত্রীদের হয়রানি কমানোর ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রেখে চলেছেন। তার প্রচেষ্টায় যাত্রী হয়রানি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
পেশাগত ব্যস্ততার পাশাপাশি তিনি একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। ছোটবেলা থেকেই পাখি ও ফুলের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা। অবসর পেলেই বাগান করেন সাথে পাখি পালনও করেন। বিরল প্রজাতির বিভিন্ন পাখি সংগ্রহে রয়েছে তার। এছাড়াও সময় পেলে তিনি পাখি দেখতে বেরিয়ে পড়েন। যেখানে পাখি, সেখানেই তার মন ভেসে বেড়ায়।