বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বিদেশি বিনিয়োগ লাভে ব্যর্থতার পোস্টমর্টেম

আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:৫৫

গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করিয়াছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সময় তিনি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করিতে তাহার সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলিয়া ধরেন এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। বাড়তি খরচ ছাড়াই করা যাইবে ব্যবসা। গত ৭ এপ্রিল হইতে শুরু হইয়াছে এই বিনিয়োগ সম্মেলন। ইহা আজ ১০ এপ্রিল শেষ হইতে যাইতেছে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ করিবার জন্য ইহার পূর্বে সকল সরকারপ্রধানই একইভাবে বিদেশিদের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন; কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমরা কতটা সফল হইয়াছি তাহা একটি প্রশ্নই বটে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একসময় আমাদের চাইতে শ্রেয় ছিল না; কিন্তু গত কয়েক দশকে বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধা লইয়া তাহারা ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে। এই সকল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান কারণ-জাপান, চীন, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, হংকং প্রভৃতি দেশের বিনিয়োগকারীদের সফল বিনিয়োগ; কিন্তু বাংলাদেশ এই ব্যাপারে বারংবার আহ্বান জানাইলেও আমরা যেই সকল পদক্ষেপ লইয়াছি তাহা বহুলাংশে বিনিয়োগবান্ধব হয় নাই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীগণ বিমানবন্দরে নামিয়াই হতাশ হইয়াছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কালক্ষেপণ, পদে পদে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ১০০ টাকার জায়গায় যদি ২০০ টাকা ব্যয় করিতে হয়, তাহা হইলে শুধু বিদেশি কেন, দেশি বিনিয়োগকারীগণও কোন দুঃখে বিনিয়োগ করিতে আগ্রহী হইবেন?

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তাহার চিত্র জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ২০২৪ সালের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন হইতে সম্যক উপলব্ধি করা যায়। তাহাতে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সমগ্র বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পৌনে ২ শতাংশ কমিলেও বাংলাদেশে কমিয়াছে পৌনে ১৪ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ (২০২৩)। ইহার কারণ কী? আইএফসি তাহাদের আরেক প্রতিবেদনে বলিতেছে যে, বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ তথা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো পাঁচটি বড় প্রতিবন্ধকতা রহিয়াছে। তাহা হইল-বিদ্যুতের সমস্যা, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও উচ্চ করহার। ইহা ছাড়া এই দেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি বা নিয়ন্ত্রণমূলক সমস্যা রহিয়াছে। রহিয়াছে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, নীতির ঘনঘন পরিবর্তন, সুশাসনের অভাব, আইনগত জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা বা দক্ষ জনবলের অভাব, সমন্বয়ের অভাব, বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি পাইতে বিলম্ব, জমির ইজারা পাওয়ার সমস্যা, বন্দরে শুল্ক জটিলতা, পরিবহন ও টেলিযোগাযোগে অবকাঠামোগত সমস্যা ইত্যাদি। অথচ দেশের চারটি খাতে প্রয়োজনীয় নীতিগত পদক্ষেপ নিলে প্রতি বৎসর এই সকল খাতে অন্তত ৩৫ লক্ষ নূতন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। এই খাতগুলি হইল-আবাসন, পেইন্ট অ্যান্ড ডাইস, তৈরি পোশাকশিল্প ও ডিজিটাল আর্থিক সেবা।

অতএব, অতীতের অনেক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্লানিমোচনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ লইতে হইবে। স্থানীয় পুঁজির দারিদ্র্য কমাইতে কিংবা প্রযুক্তি হস্তান্তরের নিমিত্তে অবশ্যই আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করিতে হইবে। কেননা বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশ উন্নতি করিতে পারে না। বিশ্বের ৩৫তম বড় অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশে আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ না আসাটা দুঃখজনক। আবার দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ জিডিপির হিসাবে এফডিআইয়ে পিছাইয়া থাকিবে কেন? সম্প্রতি মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা পর্যটন, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দিয়া উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ আনিতে সক্ষম হইয়াছে। অব্যাহত চেষ্টা থাকিলে আমরাও যে সাফল্য লাভ করিব তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। তবে এই জন্য বিনিয়োগের পরিবেশ যেমন নিরাপদ করিতে হইবে, তেমনি পুঁজি আনয়ন ও প্রত্যাবর্তন সহজ করিতে হইবে। সুদের হার ও বিনিময় হার করিতে হইবে যৌক্তিক। ইহা ছাড়া দক্ষ শ্রমিক সহজলভ্যসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধনে নজর দিতে হইবে।

সর্বোপরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজাল হইতে আমাদের বাহির হইয়া আসিতে হইবে। কেননা ইহা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হতাশ করিয়া দেয়। আর যেই সকল দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা লাগিয়া থাকে, চুরি-ডাকাতি, লুটপাট ইত্যাদি চলিতে থাকে, যে কোনো কাগজপত্র জমা দিতে গেলেই উৎকোচ দিতে হয়, সেই সকল দেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের আশা কীভাবে করা যায়? তাই এই সকল সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া যাহাতে সর্বদা শান্তিপূর্ণ হয়, সেই দিকেও খেয়াল রাখিতে হইবে।

ইত্তেফাক/এমএএস

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন