পুরাতন দিনের জীর্ণতাকে সরাইয়া নূতনত্বের আলোয় উদ্ভাসিত হইবার বাসনা আমাদের সকলের। হাজার বৎসর পূর্বের মানুষও পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়াছিল। তাহারা হয়তো চাহিয়াছিল ক্ষুধামুক্ত একটি সমাজ, চাহিয়াছিল প্রকৃতির রহস্য ভেদ করিয়া নিরাপদ আশ্রয়। পরিবর্তন আসিয়াছেও বটে। পাথরের যুগ পার করিয়া মানুষ ধাতুর ব্যবহার শিখিয়াছে, চাকা আবিষ্কার করিয়াছে, জ্ঞানের অন্বেষণে দিগ্বিদিক ছুটিয়া গিয়াছে। চাকার আবিষ্কার, লিপির ব্যবহার বা বারুদের উদ্ভব-প্রতিটি পরিবর্তনই মানবজাতিকে একটি নূতন দিগন্তে লইয়া গিয়াছে; কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষ কি ঠিক এমন পরিবর্তন চাহিয়াছিল, যেইখানে আজ আমরা দাঁড়াইয়া রহিয়াছি? আমরা যখন ভবিষ্যৎ কল্পনা করি, তখন মনে মনে ভাবি একটি ঝকঝকে, প্রযুক্তিনির্ভর, সবুজ পৃথিবী। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি সত্যিই সেই পৃথিবী পাইবে?
এই মুহূর্তে দাঁড়াইয়া আমরা যেই পরিবর্তন দেখিতেছি, তাহার গতি অভূতপূর্ব। ১৮২৫ সালে যখন প্রথম বাষ্পচালিত রেল চলিয়াছিল, তখন মানুষ ভাবিয়াছিল ইহার চাইতে দ্রুত আর কিছু সম্ভব নহে। আজ আমরা হাইপারলুপ আর মঙ্গল গ্রহে উপনিবেশের কথা ভাবিতেছি। ১৯৯০ দশকে ইন্টারনেট যখন সাধারণ মানুষের হাতে আসিয়াছিল, তখন কে ভাবিয়াছিল যে, ইহা একদিন আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, এমনকি আমাদের চিন্তাকেও বদলাইয়া দিবে? আবার আজ আমরা ভবিষ্যতের যেই ছবি আঁকি, তাহার কতটুকু বাস্তবে সম্ভব হইবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার, মহাকাশ জয়ের হাতছানি, জিন প্রযুক্তির বিস্ময়-ভবিষ্যৎ হিসাবে কত কিছুই না আমাদের চিন্তার জগতে জমা রহিয়াছে; কিন্তু ভবিষ্যৎ কি সত্যিই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে? নাকি আমরা অনিয়ন্ত্রিত এক ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান? প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, অপ্রত্যাশিত প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনা, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা-যে কোনো কিছু আমাদের পরিকল্পনার বাহিরে ঘটিয়া যাইতে পারে।
সবচাইতে বড় প্রশ্ন হইল, এই দ্রুত পরিবর্তনের সহিত আমরা কি মানাইয়া লইতে পারিব? প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে আমূল পরিবর্তন করিয়া দিয়াছে। নূতন নূতন গ্যাজেট, ভার্চুয়াল জগৎ, সামাজিক মাধ্যমের অভূতপূর্ব বিস্তার-এই সকল কিছুর সহিত তাল মিলাইয়া চলিতে গিয়া আমরা কি আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছি? আমাদের মস্তিষ্কের গঠন, আমাদের সামাজিক রীতিনীতি কি এত দ্রুত পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত? ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়াছে, গত ২০ বৎসরে প্রযুক্তির অগ্রগতি পূর্ববর্তী ২০০ বৎসরের তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ অধিক। ইহার মধ্যে কিছু কিছু আবিষ্কার পৃথিবীর চেহারাই পালটাইয়া দিয়াছে। সেই সকল যেমন জীবনকে সহজ করিয়াছে, তেমনই নূতন চ্যালেঞ্জেরও জন্ম দিয়াছে।
ভবিষ্যতে আরো কত বিস্ময় অপেক্ষা করিতেছে কে জানে? বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৮০ কোটি চাকুরি প্রযুক্তির কারণে বিলুপ্ত হইয়া যাইতে পারে। তবে ইহার বিপরীতে তৈরি হইবে ৯৭ কোটি নতুন পেশা। দূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করিব যাহা আমাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতা কমাইয়া দিবে, হয়তো আমরা মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্তে পাড়ি দিতে সক্ষম হইব, হয়তো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এমন এক সমাজ তৈরি করিব যেইখানে কোনো রোগবালাই থাকিবে না। আবার এমনও হইতে পারে, আমরা এমন কিছু আবিষ্কার করিব যাহা আমাদের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি হইয়া দাঁড়াইবে।
পরিবর্তন আমাদের পক্ষে যাইবে, নাকি বিপক্ষে-তাহা নির্ভর করে আমরা সেই পরিবর্তনকে কীভাবে গ্রহণ করিব তাহার উপর। যদি আমরা প্রযুক্তির দাস না হইয়া তাহার সদ্ব্যবহার করিতে পারি, তাহা হইলে পরিবর্তনকে আমাদের পক্ষে কাজে লাগাইতে পারিব। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, প্রকৃতির সহিত ভারসাম্য বজায় রাখিতে হইবে, কারণ প্রযুক্তি যতই উন্নত হউক না কেন, প্রকৃতি ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব অসম্ভব। পরিবর্তনকে আটকানো যায় না; কিন্তু ইহাকে গাইড করা যায়। আমাদের পূর্বপুরুষ যেমন আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করিয়া সভ্যতা গড়িয়াছে, আমাদেরও তেমনি প্রযুক্তি ও পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করিতে শিখিতে হইবে। ভবিষ্যৎ হয়তো আমাদের কল্পনার জগৎ হইতে ভিন্ন হইবে; কিন্তু সেটি আমাদের হাতেই গড়িয়া উঠিবে।