বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার আশঙ্কাজনক

কর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা

আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৫৯

শিক্ষাবিদরা বলছেন, কর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না দেশের প্রচলিত শিক্ষা। এজন্য দিন দিন শিক্ষিত ও তরুণ বেকারের চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনক। পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে একই তথ্য। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার গত ১৩ বছরে আট গুণ বেড়েছে। ২০১০ সালে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাশ বেকার ছিল মোট বেকারের ৪.৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৫০ শতাংশে।

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমদ খান বলেন, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ হিসেবে বর্তমান সরকার সারা দেশে ৩২৯ উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের আওতায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। 

বর্তমানে বাংলাদেশের আটটি বিভাগের অন্তর্গত ৬৪টি জেলায় মোট ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক বলেন, ‘যারা শিক্ষিত তারা যে কোনো কাজ করতে পারেন না। তারা চান অফিসিয়াল কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থানই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এখানে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা কম। ফলে তারা বেকার থাকছেন।’ সরকারি হিসাব বলছে, যাদের কোনো শিক্ষা নেই, তাদের বেকারত্ব হাজারে ১৫৩ জন, কিন্তু স্নাতক বা স্নাকোত্তর শেষ করাদের মধ্যে বেকার হাজারে ৭৯৯ জন। গত ৪ এপ্রিল সকালে হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমদ খান আরো বলেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থানে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার উল্লিখিত প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি উপজেলায় ৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। কোনো দানশীল ব্যক্তি জমি দান করতে চাইলে তা সাদরে গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যে নবীগঞ্জ ও বাহুবলের জন্য দুই জন দানশীল ব্যক্তি ভূমি দান করেছেন বলে জানান তিনি।

দেশের ১০০ উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপন প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে। ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে। অথচ অবহেলা, অপরিকল্পনায় বারবার বেড়েছে সময়। একই সঙ্গে ব্যয় বেড়েছে ২৭৩ শতাংশ। ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা বেড়ে এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫২০ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। এর পরও প্রকল্পের কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পের কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করে এমন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আড়াই বছরের প্রকল্প ১২ বছরে গড়ানোর মধ্যে তিন বার করে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রকল্পের আওতায় নানা ধরনের অপ্রাসঙ্গিক খরচও সচল রাখা হয়েছে। এতে সরকারি অর্থের বিপুল অপচয় হয়েছে বলে মূল্যায়ন সরকারি প্রকল্প তদারকি সংস্থার।

জানা গেছে, দেশের যেসব উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ নেই অথবা সরকারি ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও সরকারি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার নেই সেসব উপজেলা থেকে নির্বাচিত ১০০টিতে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ৫৫টি টিএসসির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩টি শর্তসাপেক্ষে হস্তান্তর হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৫টি টিএসসির মধ্যে ১৯টির পূর্ত ও নির্মাণকাজ হয়েছে ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ, ১৪টির ৫০ শতাংশ ও তিনটির ২৫ থেকে ৪৯ শতাংশ কাজ হয়েছে।

ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দেওয়া তথ্যমতে,  প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্নাতক পাশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকার ৩০ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৮ শতাংশ। গোটা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় শিক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে ৫০ ভাগের কম শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার দিকে যায়। বাকি ৫০ ভাগ স্বল্পমেয়াদে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে কাজ খুঁজে নেয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক (অষ্টম শ্রেণি) শিক্ষার পরই শুরু হয় বাছাই প্রক্রিয়া। লেখাপড়ার প্রতি যাদের আগ্রহ কম, তাদের পাঠানো হয় ভোকেশনাল শিক্ষায়। দ্বাদশ শ্রেণির পর আবারও বাছাই করে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয় কারিগরি শিক্ষায়। বাকিরা উচ্চশিক্ষার জন্য অনুমতি পায়। বাংলাদেশে প্রায় ৯ হাজার কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক ইত্তেফাককে বলেন, দেশের দেড় শতাধিক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৫০ মহাবিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হয় সাড়ে ৩ লাখ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে দেড় লাখ শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান হলেও ২ লাখ থেকে যায় উপযুক্ত কাজের বাইরে। আমাদের দেশে এতসংখ্যক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশেই কারিগরি শিক্ষা সহজলভ্য। অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৃত্তি প্রদান করা হয়। শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায় কর্মসংস্থান। আমাদের দেশেও সময় হয়েছে উচ্চশিক্ষার বদলে ভর্তুকি দিয়ে হলেও কারিগরি শিক্ষা উত্সাহিত করা।

ইত্তেফাক/এনএন