আজ পহেলা বৈশাখ, শুরু হচ্ছে নতুন বাংলা সাল ১৪৩২। নতুন বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হচ্ছে গ্রীষ্মকাল। এবার চৈত্রের শুরু থেকেও তীব্র গরম টের পাচ্ছিলো দেশবাসী, সঙ্গে ছিল কয়েকটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস। এটা খুবই শঙ্কার কথা যে, বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১.২°সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত ৫৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৫,০০০-৬,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে তাপপ্রবাহ ও সংশ্লিষ্ট রোগব্যাধির কারণে। গ্রীষ্মকালকে বরণ করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতা বিষয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে এই গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতা থেকে দূরে থাকা যায়, এই সময়ে অসুস্থতার কারণ ও এদের স্বাস্থ্যগত, সামাজিক, ও অর্থনৈতিক প্রভাব এবং অসুস্থতাসমূহের প্রতিরোধে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় পর্যায়ে করণীয়সমূহ নিয়ে ইত্তেফাকের জন্য লিখেছেন চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজির (ইউএসটিসি) ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ বিল্লাল হোসাইন।
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতাসমূহ সাধারণত কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি তাপজনিত অসুস্থতা। হিট স্ট্রোক, হিট এক্সহশন এবং হিট ক্র্যাম্প বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকি। ২০২৩ সালে হিট স্ট্রোকে ১১২ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে।
তাপজনিত অসুস্থতা ছাড়াও পানিবাহিত অসুস্থতাও হতে পারে গরমে। ডায়রিয়া, কলেরা এবং টাইফয়েড গ্রীষ্মকালে ব্যাপকভাবে ছড়ায়। আইসিডিডিআর,বি-এর তথ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়।
পানির সঙ্গে খাদ্যজনিত অসুস্থতাও জড়িয়ে। ফুড পয়জনিং এবং আমাশয় গ্রীষ্মে বেশি দেখা যায়। খাদ্যে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সমস্যা বাড়ে।
খাবার ও পানি ছাড়াও শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতা দেখা যায় গরমে। বায়ুদূষণ এবং ধুলাবালির কারণে অ্যাজমা, এলার্জি এবং শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গ্রীষ্মে বায়ুদূষণ ৩০% বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতাসমূহের প্রভাব
গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহ মানুষের শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কিডনি সমস্যা, হৃদরোগের ঝুঁকি এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষ ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রীষ্মকালে শ্রম উৎপাদনশীলতা ৩০-৪০% হ্রাস পায়। কৃষি উৎপাদনও ১৫-২০% কমে যায়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন, নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিস্তার এই মৌসুমের উল্লেখযোগ্য সামাজিক প্রভাব।
কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতাসমূহ প্রতিরোধ করতে পারে। যেমন দিনে কমপক্ষে ৩-৪ লিটার পানি পান করা, সুতি ও হালকা রঙের পোশাক পরিধান, বাইরের খোলা খাবার এড়িয়ে চলা, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। এগুলোতো গেল ব্যাক্তিগত পর্যায়ে সাবধানতা।
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কারখানা, অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যেমন পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা, কর্মী ও শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত শীতল স্থানে কাজ বা ক্লাসের ফাকে বিশ্রামের ব্যবস্থা, জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণ, তাপপ্রবাহ বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান ইতযাদি।
যদিও এরইমাঝে গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহল কিছু সফল উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা, ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট এর ব্যাপক ব্যবহার, জরুরি সতর্কতা ব্যবস্থা চালু।
এদিকে, আন্তর্জাতিক সফল উদ্যোগগুলোকে মাথায় রেখে আমাদের দেশও অন্যান্য দেশ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে। যেমন ভারতের আহমেদাবাদ মডেল থেকে তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় ধারণা গ্রহণ, সিঙ্গাপুরের সবুজ নগর পরিকল্পনা থেকে তাপমাত্রা কমানোর কার্যকরী উপায়, জাপানের তাপপ্রবাহ মোকাবেলা কৌশল।
তবে লেখক মনে করছেন, গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতাসমূহ প্রতিরোধে বাংলাদেশের জন্য কিছু বাধা রয়েছে, যা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, সীমিত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সম্পদ, জনসচেতনতার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব।
কিন্তু চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সম্ভাবনার কথাও ভুলে গেলে চলবে না। যেমন তরুণ ও কর্মক্ষম জনশক্তির প্রাচুর্য, ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।
সেইসঙ্গে গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতাসমূহ প্রতিরোধে বাংলাদেশে কী পদক্ষেপ নিতে পারে তাও জানিয়েছেন পাবলিক হেলথের এই অধ্যাপক।
স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ
প্রতিটি জেলায় হিট ওয়েভ ম্যানেজমেন্ট সেল গঠন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষ হিট স্ট্রোক ইউনিট স্থাপন ও গণমাধ্যমে নিয়মিত সতর্কতা বার্তা প্রচার।
দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ
জলবায়ু সহিষ্ণু স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা, গবেষণা ও উন্নয়নে বাড়তি বিনিয়োগ, নগর পরিকল্পনায় সবুজায়নের উপর জোর দেওয়া, শিক্ষা কার্যক্রমে জলবায়ু ও স্বাস্থ্য বিষয়ক অধ্যায় সংযোজন।
গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, এবং পরিবেশ বিষয়ক একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ সময়ে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নয়, জনসচেতনতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই, গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতাসমূহ প্রতিরোধে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র - তিনটি স্তরেই সমানভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। বাংলাদেশ যদি সময়োপযোগী পরিবেশ নীতি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রীষ্মকালীন অসুস্থতাসমূহ থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা অনেকটাই সম্ভব। আর সেজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সকল জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সদিচ্ছা, এবং নাগরিকদের সচেতন উদ্যোগসমূহে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ,
ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি চিটাগং (ইউএসটিসি)