বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

চক্ষুদ্বয়ের উপরে ভরসা রাখুন, নয়তো কপালের উপর! 

আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:০০

সাভারের আশুলিয়ায় একটি যাত্রীবাহী লেগুনা সড়কের পাশের খোলা ড্রেনে পড়িয়া দুই পোশাকশ্রমিক নিহত হইয়াছেন। এই ঘটনায় আহত হইয়াছেন আরো অন্তত তিন জন। গত ১৬ এপ্রিল রাতে বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের জামগড়া ফ্যান্টাসি কিংডমের সম্মুখে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রবাদ আছে, যস্মিন দেশে যদাচার; অর্থাৎ যেই দেশে যেই নিয়ম। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলিতেও চলাচল করিবার কিছু নিয়ম রহিয়াছে। তাহা হইল মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নিজের দুইটি চক্ষুর ওপর ভরসা করিয়া চলাচল করা। সুতরাং সাভারের আশুলিয়ায় সড়কের পাশের খোলা ড্রেনে দুই জন পোশাকশ্রমিক নিহত হইলেন-এই সংবাদে বিস্ময়ের কিছুই নাই। বিস্ময় প্রকাশ করিবে কে? আমরা তো বহু আগেই এই সকল ঘটনায় অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সড়ক দুর্ঘটনা, খোলা ড্রেন, নির্মাণাধীন ভবনের পার্শ্বে ফেলিয়া রাখা রড, কিংবা উপর হইতে ইট পড়িয়া আহত বা নিহত খবর যেন প্রতিদিনকার রুটিন।

কাহারো মুখে 'কেন এমন হইল' শুনিলেও তাহা এক শ্রাবণসন্ধ্যায় বিদ্যুচ্চমকের মতো ক্ষণস্থায়ী। পরদিনই মানুষ তাহা ভুলিয়া যায়। আশুলিয়ার দুঃখজনক এই দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে ১৬ এপ্রিল, জামগড়ার ফ্যান্টাসি কিংডমের সম্মুখে। দুর্ঘটনার আশপাশের এই স্থাপনার নামটি শুনিলে যেন এক রূপকথার স্বপ্নরাজ্যের গন্ধ পাওয়া যায়- 'ফ্যান্টাসি কিংডম'! অথচ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই যেন বাস্তবের 'ফ্যান্টাসি'-যেই খানে ড্রেন থাকে খোলা, সাইন-সিম্বল থাকে অনুপস্থিত, আর জনগণ থাকে নেহাত ভাগ্যের ভরসায়! এই সকল দেশে খোলা ড্রেনের পার্শ্বে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড থাকিবে, এমন প্রত্যাশা করাটাও যেন পরিহাসতুল্য।

অথচ উন্নত দেশে চলাচলের পথটি শুধু যাত্রী নহে, পথটিও যেন নিজের দায়িত্ব পালন করে। পথ নিজেই সতর্ক করে: 'সাবধান! বিপদ সম্মুখে!' কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলির পথই যেন রোগাক্রান্ত। তাহার কিছু বলিবার নাই, সে রাখে না কোনো সতর্কতা, সে কেবল মৃত্যুর ফাঁদ পাতিয়া রাখে। প্রশাসনের নিকট প্রশ্ন করিলে বেশির ভাগ সময় বলা হইয়া থাকে- 'এই বিষয়ে তদন্ত করিয়া দেখা হইবে'। তদন্তের সময় তালিকা প্রস্তুত হইবে, প্রতিবেদন লিখা হইবে, দায়সারা তর্জনী উঠিবে কোনো নিম্নপদস্থ কর্মচারীর দিকে। ইহার পর সকলের ভুলিয়া যাওয়া এবং আবার অপেক্ষা করা আরো একটি দুর্ঘটনার। ইহা যেন এক প্যাঁচকাটা চক্র-মৃত্যু, নিন্দা, তদন্ত, বিস্মরণ এবং পুনরায় মৃত্যু। 

তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে পথচলতি মানুষদের একটি বিশেষ নিয়ম জানা থাকা জরুরি। তাহা হইল-চলিবার সময় দুই চক্ষু খুলিয়া রাখিতে হইবে। তাহাও অবশ্য যথেষ্ট নহে। চাই তৃতীয় নয়ন, কিংবা অন্ততপক্ষে ভবিষ্যৎ দর্শন করিবার ক্ষমতা। কেননা এইখানে যাত্রা মানেই যুদ্ধ। ড্রেনের সঙ্গে, গর্তের সঙ্গে, হঠাৎ উধাও হইয়া যাওয়া রেলিং কিংবা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে। এইখানে মানুষ রাস্তায় নামে জীবন হাতে লইয়া, আর ফিরিয়া আসে ভাগ্যগুণে।

জনগণেরও কিছু দায় রহিয়াছে বটে। আমরা পথ চলিতে শিখিয়াছি, কিন্তু সচেতন চলা শিখি নাই। রাস্তার দোষ দেখাই, অথচ রাস্তার পার্শ্বে ময়লা ফেলি। প্রশাসনের ব্যর্থতা বলি, অথচ নিজের মোবাইলে ব্যস্ত থাকিয়া গর্তে পড়িয়া যাই। এই সমষ্টিগত উদাসীনতার দায়ভার নিতে আমরা প্রস্তুত নহি। তবে কে দায়ী? রাস্তা? প্রশাসন? জনগণ? নাকি কপাল? যেহেতু কেহই দায় লইতে চাহে না, কপালকেই কোর্টে হাজির করা যাইতে পারে। আগামী দুর্ঘটনায় হয়তো বলা হইবে-'এই মৃত্যুর দায় তোমার কপাল!'

সুতরাং, সদা সতর্ক থাকুন। নিজের চক্ষুদ্বয়ের উপর পূর্ণ ভরসা রাখুন। কেননা, এইখানে জীবন রক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করিলে আমরা এমন ড্রেনে পড়িতেই পারি! অতএব, নিজেদের রক্ষা করিবার কথা নিজেরাই ভাবুন। ইহা মানিয়া লওয়াই ভালো যে, কোনো দুর্ঘটনার জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে! আমরা যে পর্যন্ত না উন্নত দেশের ন্যায় 'সভ্য না হইয়া উঠিতেছি, ততদিন এমন দুর্ঘটনা আমাদের জন্য কি ললাটের লিখন হিসাবেই বিবেচিত হইতে থাকিবে?

ইত্তেফাক/এএম