বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বুক ভরা আশায়, আগামী রমজানের অপেক্ষায়

আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৫

রমজান তো পথের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা হাত-পাহীন একজন ভিক্ষুককেও নিরাশ করেনি, গণপরিবহনে ফেরি করে দোয়া-কিতাব বিক্রেতাও যেখানে হতাশ হয়নি। সেখানে সুগভীরভাবে রমজানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে আন্তরিকভাবে দোয়াকারী, বিশুদ্ধ ও আনন্দে ভরা নামাজ আদায়কারী, নিবেদিত গোলামির প্রমাণিত রোজা পালনকারী, কুরআনকে ভালোলাগা-ভালোবাসার উৎস বানানোর প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ব্যক্তি, সংকীর্ণ দুনিয়াদারির টান থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে ইতিকাফ পালনকারী—কেউই কোনোভাবে হতাশ-নিরাশ হতে পারে না। রমজান পালনের এসব সুনির্দিষ্ট সূচকের অফুরন্ত প্রভাব-প্রতিক্রিয়া রমজান পালনকারীর শরীর-মন-মগজে কমবেশি অবশ্যই গেঁথে গেছে।

এসব কারণে একজন রমজান পালনকারী খুবই দৃঢ় আস্থাশীলতাসহ নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান মনে করবেন। মহামহিম প্রভুর কাছে রমজানের প্রাপ্তি নিয়ে সব সময় আনন্দিত থাকা-আশান্বিত হওয়ার সার্বক্ষণিক আকুতি জানাতে থাকবেন। বুক ভরা আশায়—আগামী রমজানের অপেক্ষায় থাকবেন। রমজানের ছোটখাটো আয়োজনও তো সমাজের বেশির ভাগ মানুষকেই খুব শীঘ্রই আরো এক রমজান পাওয়ার ব্যাপারে অসামান্য আগ্রহী করে তুলেছে। তাহলে রমজানের আসল ফায়দা হাসিলকারীরা কেন সামনের রমজানকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে মনে করে দুহাত-পা গুটিয়ে অকর্মণ্য অথব হয়ে বসে থাকবে? বরং প্রকৃত রমজান পালনকারীরা যে বুক ভরা আশা নিয়ে আগামী রমজানের অপেক্ষা করবেন, তা মাত্র একটা হাদিসের বর্ণনা উপলব্ধি করলেই সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। হাদিস বলছে, রোজাদারের জন্যে দুটি আনন্দ। একটি ইফতারির সময়, অন্যটি যখন সে তার মালিকের সঙ্গে মোলাকাত করবে। প্রত্যেক রোজা পালনকারী তো রসুলের এ হাদিস বিশ্বাস করেই রোজা পালন করেছেন। ইফতারির আনন্দের মূল কারণ কোনোভাবেই ইফতারির খাদ্যনির্ভর ছিল না। এটা ছিল সুদীর্ঘ সময় মালিকের একটা অত্যন্ত সুকঠিন নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করতে পারার আনন্দ। সত্যিই যদি কেউ এ আনন্দের আসল স্বাদ অনুভব করে থাকেন, তাহলে তিনি এখনো সে আনন্দের ধারায় যুক্ত থেকে সামনে অগ্রসর হবেন, যাতে তিনি রোজাদারের চূড়ান্ত আনন্দের স্থানে পৌঁছতে পারে। চূড়ান্ত আনন্দের এ অপেক্ষা তাকে প্রতিনিয়ত আনন্দের সাগরে দোলাতে থাকবে। তার আনন্দ কখনো শেষ হবে না।

রমজানকে কেন্দ্র করে মানবজাতির জন্য যে অফুরন্ত দয়া ও করুণার ভান্ডার উন্মুক্ত করা হয়েছিল, জীবনের সব অপরাধ-গুনাহ আর পাপ থেকে মাফ করে ক্ষমা করে মুক্তি দিয়ে আমাদেরকে যে-সদ্য প্রসূত শিশুর নিষ্পাপতা উপভোগ করানো হয়েছিল, তার স্বাদ তো রমজান চলে যাওয়ায় শেষ হয়ে যায়নি, বরং এখনো তা চলছে। রমজানে জাহান্নাম থেকে নাজাত দিয়ে যে আনন্দ উপভোগ করানো হয়েছে, তা তো আর কখনো বন্ধ হওয়ার কথা নয়।

রমজানের এসব প্রাপ্তি অনাগত ভবিষ্যতেও চালু রাখতে রমজান সাফল্যের সব বিষয়াদির উত্তরোত্তর অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হবে। রমজান বিদায় হতে না হতেই শওয়ালের ছয় রোজা, প্রতি সপ্তাহের সোম-বৃহস্পতির রোজা, প্রতি মাসের ১৩-১৫ আইয়ামবিজের রোজা, ১-৯ জিলহজের রোজা, আরাফাত দিবসের রোজা, আশুরার রোজা ইত্যাদি বছর ধরে রোজার এ মহড়া রোজাদারকে সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকেই অগ্রসর করানোর আয়োজন।

একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে রমজান তার কোনো কিছুই তার সঙ্গে কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি। রমজান আনুষ্ঠানিকতার বিষয়াদি; যেমন— দোয়া, নামাজ, কুরআন, ইতিকাফ, মানবসেবা-সমাজসেবা, মালিকের নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির মডেল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা—রমজানের বিদায়ের কারণে এর একটিও বন্ধ করা হয়নি। প্রতিদিন প্রত্যেক ফরজ নামাজ শেষে, প্রতি সোম-বৃহস্পতি- শুক্রবার বাদ আসর, প্রতি রাতের শেষ অংশে এবং ছোট-বড় যে কোনো ভালো কাজ শেষে দোয়া করা এবং দোয়া কবুলের ব্যবস্থা রয়েছে। রমজানের বিশেষ নামাজ তারাবির কথা বাদ দিলে রমজান চলে যাওয়ার কারণে নামাজ বিষয়ে নামাজির তেমন আর কোনোই কমতি হয়নি।

রমজান মানুষের হেদায়েতের জন্য কুরআন নিয়ে এসেছিল, তা রমজান তার সঙ্গে ফেরত নিয়ে যায়নি। বরং তা সম্পূর্ণভাবে রমজান পালনকারীদের আয়ত্তে রেখে গেছে। রমজানের শেষ ১০ দিনের সুন্নাহ ইতিকাফের সুযোগ না থাকলেও এখন যে কেউ যে কোনো সময় নফল ইতিকাফ করতে পারেন। আল্লাহর বাণী প্রচার এবং আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়গুলিও রমজানে যেভাবে প্রযোজ্য ছিল, সামান্যতম হেরফের ছাড়াই সেগুলি একইভাবে এখনো প্রযোজ্য। এই সুগভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় আস্থাই হলো ইমান ও ইহতিসাব, যা রমজানের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। এই ইমান ও ইহতিসাবের ফল্গুধারা আমদেরকে এখনো ভুলে যেতে দেবে না—'লা তাকনাতু মির রহমাতিল্লাহ— আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ হয়ো না'; অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ফিরে এলেই আশ্রয়ের নিশ্চয়তা রয়েছে।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এনএন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন