ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে সশস্ত্র অবস্থায় ৫ যুবককে অপহরণ করা হয় র্যাব পরিচয়ে। অপহৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন বিজিবির এক সদস্যও। সেসময় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন। তাতে ফল হয়নি। পুলিশ গত একযুগে অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে পারেনি।
একসঙ্গে ৫ ব্যক্তিকে অপহরণের ঘটনাটি ঘটেছিল নাটোরের বড়াইগ্রামের বনপাড়া পৌর শহরের মহিষভাঙ্গা ও কালিকাপুর, জোয়াড়ি ইউনিয়নের কাটাশকুল এবং মাঝগ্রাম ইউনিয়নের গুডুমশৈল এলাকায়। ২০১৩ সালের ১৯ মে রাত ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। অপহরণের পর থেকে এই তিনটি এলাকার মানুষের মধ্যে বেড়েছে আতঙ্ক।
স্থানীয় লোকজন ও অপহৃত ব্যক্তিদের পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, গুডুমশৈল গ্রামের রুহুল আমীনের ছেলে ইব্রাহিম খলিল (৩৫), একই গ্রামের শাহজাহানের ছেলে কামাল হোসেন (৩২), মহিষভাঙ্গা গ্রামের আবু বক্করের ছেলে তৈয়ব আলী (৩২), কালিকাপুর গ্রামের গাজী ওমর ফারুকের ছেলে বিজিবি সদস্য রাসেল গাজী এবং কাটাশকুল গ্রামের আফতাব উদ্দিন মৃধার ছেলে কলেজ ছাত্র মো. সেন্টু হোসেন ১২ বছর আগে একসঙ্গে অপহরণের শিকার হয়েছেন। দীর্ঘ সময় সন্ধান পাওয়া না গেলেও স্বজনেরা চোখের জলে এখনো দিন গুনছেন প্রিয়জনের ফেরার।
সে দিন যা ঘটেছিল
অপহৃত পরিবারের লোকজন বলছেন, সেই রাতে র্যাবের পোশাক পরিহৃত অন্তত ১৪ থেকে ১৫জন সশস্ত্র ব্যক্তি তিনটি মাইক্রোবাসে প্রথমে বড়াইগ্রাম উপজেলার গুডুমশৈল গ্রামে আসেন। সেখানে কোনো কারণ ছাড়াই ওই গ্রামের রুহুল আমীনের বাড়িতে হানা দিয়ে তার ছেলে ইব্রাহিম খলিল ও প্রতিবেশী শাহজাহানের ছেলে কামাল হোসেনকে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। এর পর পার্শ্ববর্তী মহিষভাঙ্গা গ্রামে গিয়ে একইভাবে তুলে নেওয়া হয় আবু বক্করের ছেলে তৈয়ব আলীকে। বাজারে যাওয়ার সময় তুলে নেওয়া হয় কালিকাপুর গ্রামের গাজী ওমর ফারুকের ছেলে বিজিবি সদস্য রাসেল গাজীকে।
সর্বশেষ কাটাশকুল গ্রামে গিয়ে মোবাইল কোম্পানির প্রহরী সুমন প্রামাণিককে বাড়িতে না পেয়ে তার বাবা লস্কর প্রামাণিককে রাইফেলের বাট এবং বাঁশের লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। স্ত্রী সন্তানদের সামনে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে এক পর্যায়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান।
পরদিন ২০ মে সকালে নাটোর র্যাবের অফিসে গিয়ে অপহৃত ব্যক্তিদের দেখা পাননি। ফিরে এসে পৃথক ৪টি সাধারণ ডায়েরি করেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। মামলা দায়ের করেন বিজিবি সদস্য রাসেল গাজীর পিতা গাজী ওমর ফারুক। অপহৃত ব্যক্তিরা উদ্ধার না হওয়ায় এই চারটি গ্রামে সুনসান নীরবতা নেমে এসেছে। রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পুলিশের ভূমিকা
অপহরণের দীর্ঘ ১২ বছরে এক বারের জন্যও পুলিশ তদন্তের জন্য এসব গ্রাসে আসেনি। খোঁজ খবর নেয়নি অপহৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের।
অপহৃত তৈয়ব আলীর মা হাসিনা বেগম (৬৫) ইত্তেফাককে বলেন, রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তার বুকের ধনকে তুলে নিয়ে গেল র্যাবের লোকজন। তারপর থেকে আর সন্তানের দেখা পাননি তিনি। এখন নাতী আর পূত্রবধূকে আঁকড়ে ধরে কষ্টে দিন পার করছেন। সন্তানের সন্ধান পেতে র্যাবের নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী ও বাগমারা অফিসে কতবার গিয়েছেন তার হিসেব নেই। তার চোখের জলের মূল্য নেই র্যাব-পুলিশের কাছে। এখনো সন্তানের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
কামাল হোসেনের পিতা শাহাজাহান ইত্তেফাককে বলেন, অপহরণের বছরখানেক আগে সন্তানকে বিয়ে দিয়েছিলেন। একটা বাচ্চাও হয়েছে। সেই ছেলেকে তুলে নিয়ে গেল র্যাব। ১২ বছরে আর ছেলের খোঁজ পেলেন না। অভিযোগ দায়ের করা থাকলেও পুলিশ-র্যাব তাদের কোনো সহযোগিতা করেননি। বার বার ধমকে তারিয়ে দিয়েছেন।
তবে নাটোরের পুলিশ মোহাম্মদ আমজাদ ইত্তেফাক বলেছেন, ৫ ব্যক্তি অপহরণ বা গুমের যে অভিযোগ রয়েছে তা বর্তমানে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কিছু ক্লুও তাদের হাতে এসেছে। বেশ কিছু বিষয়কে সামনে রেখে বিষয়টিকে তদন্তের পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে।
পরিবারের লোকজনের আকুতি
অপহৃত ইব্রাহিমের পিতা রুহুল আমীন ইত্তেফাককে বলেন, তার ছেলে কৃষক। সারাদিন মাঠে কাজ করেন। কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। অথচ তার বুকের ধনকে র্যাব ধরে নিয়ে গুম করে রেখেছে। ইব্রাহীম ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অপহরণের পর অর্থাভাবে তিন নাতী-নাতনির লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি তার সন্তানকে ফেরতের দাবি জানান সরকারের কাছে।
অপহৃত রাসেল গাজীর পিতা গাজী ওমর ফারুক ও মা জুলেখা বিবি বলেন, এই দীর্ঘ সময়ে বহু খুঁজেও সন্তানের সন্ধান পাননি। ছেলেটি মৃত না জীবিত তা তারা জানেন না। অনেক কষ্টে সন্তানকে বিজিবিতে চাকরি দিয়েছিলেন। ছুটি কাটাতে বাড়িতে এসে ছেলেটি অপহরণ হয়েছে। তিনি সন্তানকে ফিরে পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।
কলেজ ছাত্র সেন্টু হোসেনের বৃদ্ধ পিতা আফতাব উদ্দিন মৃধা বলেন, ‘ছেলে অন্যায় করলে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। কিন্তু অপহরণ করে বছরের পর বছর গুম করে রাখা তো বেআইনি। তিনি অপহরণকারীদের বিচার দাবি করেন।
৫ ব্যক্তির অপহরণের সত্যতা নিশ্চিত করে নাটোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আমজাদ বলেন, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ব্যক্তিগত বিরোধের ঘটনাও সামনে এসেছে সেটাও তদন্তের মধ্যে রাখা হয়েছে। অপহরণের সঙ্গ পুলিশ অথবা র্যাবের কোনো সদস্য জড়িত ছিল কিনা, সেই সময়ের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। তিনি আশা করছেন অপহরণের বিষয়ে দ্রুতই সমাধান করতে পারবেন।