বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ফিলিস্তিনিদের একজন স্পষ্টবাদী সমর্থক ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস

আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:০৫

২০১৩ সাল থেকে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা পোপ ফ্রান্সিস ৮৮ বছর বয়সে  সোমবার (২১ এপ্রিল) মারা গেছেন। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে একজন গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর।

পোপরা সাধারণত বিশ্বব্যাপী সংঘাতে পক্ষ নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন। কিন্তু ১৬ মাস ধরে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচারে বোমাবর্ষণের বিষয়ে ফ্রান্সিস তার অবস্থান প্রকাশ করার সময় কখনো পিছপা হননি।

খ্রিস্টধর্মের তিনটি প্রধান শাখার মধ্যে সবচেয়ে বড় - প্রায় ১.৪ বিলিয়ন রোমান ক্যাথলিকদের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ফ্রান্সিস গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার সময় যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে গাজায় ৫১,২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ধর্মীয় গবেষণা বিশেষজ্ঞ ড. জর্ডান ডেনারি ডাফনার বলেন, পোপ যুদ্ধবিরতি, সহিংসতা বন্ধ, গাজাবাসীদের কাছে শক্তিশালী মানবিক সহায়তার আহ্বানে অত্যন্ত স্পষ্টভাষী ছিলেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। ফিলিস্তিনিদের সমতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে, পোপ এই অবস্থানটি ধরে রেখেছিলেন।

ক্যাথলিক-মুসলিম সংলাপ, ইসলামোফোবিয়া এবং মুসলিম-বিরোধী বৈষম্যের ওপর বই লেখা ডেনারি ডাফনার আরও বলেন, পোপ ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক কণ্ঠস্বর, বিশেষ করে ক্যাথলিকদের 'ন্যায়বিচারের জন্য চাপ দেওয়া এবং শান্তির জন্য চাপ দেওয়া সম্পর্কে' বিশ্বাসের কথা বলতেন।

ফ্রান্সিস পোপের কর্তৃত্ব গ্রহণের অনেক আগে থেকেই ভ্যাটিকান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তবে আগের পোপ সেন্ট জন পল দ্বিতীয়, যিনি ১৯৭৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ছিলেন, তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।

পরে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রোমান ক্যাথলিক চার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমানা অনুসারে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। এই পদক্ষেপটি ইসরায়েলকে 'হতাশ' করেছিল।

ডাফনার বলেন, প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস তার বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, ফিলিস্তিনিরা অবিচারের শিকার হচ্ছে এবং তাদের ইসরায়েলি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমান অধিকার প্রাপ্য। তিনি প্রায়শই গাজার কথা ভেবে বেদনা প্রকাশ করে বলতেন 'এত নিষ্ঠুরতা, শিশুদের মেশিনগানের গুলি, স্কুল ও হাসপাতালে বোমা হামলা...কত নিষ্ঠুরতা!'

ইসরায়েলের গণহত্যার যুদ্ধের প্রথম দিকে, ফ্রান্সিস তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'দয়া করে আক্রমণ এবং অস্ত্র (পাঠানো) বন্ধ করুন। (যুদ্ধ) কেবল নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু এবং দুর্ভোগের দিকে পরিচালিত হচ্ছে। যুদ্ধ সর্বদাই একটি পরাজয়! প্রতিটি যুদ্ধই একটি পরাজয়!'

২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর গাজার গ্রীক অর্থোডক্স পোরফিরিয়াস গির্জায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ১৮ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়। সে সময় ফ্রান্সিস ইসরায়েলকে যুদ্ধের দ্রুত অবসান ঘটাতে দাবি জানান। তিনি বলেন, 'আমি গাজার গুরুতর মানবিক পরিস্থিতির কথা ভাবছি... মানবিক সাহায্য যাতে পৌঁছাতে পারে তার জন্য জায়গা খোলার জন্য আমি আমার আবেদন পুনর্ব্যক্ত করছি।'

ইসরায়েল যখন গাজাজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করছিল, তখন পোপ ফ্রান্সিস গাজার অবরুদ্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জা হলি ফ্যামিলি চার্চে রাতের বেলা ফোন করে প্রার্থনা করতেন এবং এর দেয়ালের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া খ্রিস্টান ও মুসলিম উভয়কেই উৎসাহিত করতেন।

গাজার প্যারিশ পুরোহিত ফাদার গ্যাব্রিয়েল রোমানেলি বলেছেন, পানি, খাদ্য এবং চিকিৎসা সরবরাহের ঘাটতির মধ্যে পোপের অটল সমর্থন থেকে অবরুদ্ধ (গাজার) সম্প্রদায় শক্তি অর্জন করেছে।

ডাফনার বলছিলেন, ফ্রান্সিস গাজার পুরোহিত এবং ধর্মসভার সঙ্গে প্রতিদিনের ফোনকলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন, এমনকি হাসপাতালের বিছানায় থেকেও।

তিনি বলেন, ক্যাথলিক শিক্ষা সত্যিই স্পষ্ট যে, যখনই নিরীহ মানুষদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, যখন খাবার আটকে দেওয়া হচ্ছে, যখন পর্যাপ্ত আশ্রয়ের অভাব হচ্ছে, যখন চিকিৎসা সুবিধা ধ্বংস করা হচ্ছে - তখন আমাদের দায়িত্ব হলো যারা কষ্ট পাচ্ছে, তাদের পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলা।

পোপ গাজায় ইসরায়েলের হাতে নিহত ফিলিস্তিনিদের আত্মীয়দের সাথেও দেখা করেন। সাক্ষাতের পর পোপ মন্তব্য করেন, 'এটা আর যুদ্ধ নয়, এটা সন্ত্রাসবাদ।'

ইত্তেফাক/এসকে