পাহাড়ের বুক চিরে যখন সূর্য ওঠে, তখন পোপা বদলাপাড়ার ছোট্ট শিক্ষার্থীরা খালি পায়ে হেঁটে চলতে শুরু করে তাদের নতুন স্কুলে। চারপাশে কুয়াশা, বাতাসে গাছের পাতার ফিসফাস, আর ওই পথ ধরে ছুটে চলছে এক তরুণের স্বপ্নের গাড়ি—যার গন্তব্য শুধু একটি বিদ্যালয় নয়, একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ।
পাহাড়, পথ আর প্রতিজ্ঞার গল্প
বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোপা বদলাপাড়া। উঁচুনিচু পথ বেয়ে হেঁটে পৌছাতে হয় এই গ্রামে। বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি নেই, হাসপাতাল নেই; ছিল না কোনো স্কুল। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর ২০২৪ সালের ২৭ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে পোপা বদলা আশা-হোফনূং আনন্দময়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের পেছনে আছেন একজন নীরব যোদ্ধা, স্বপ্নদ্রষ্টা ও শিক্ষক তরুণ—উথোয়াইয়ই মারমা।
শৈশবের ছায়া পেরিয়ে আশার আলোয়
উথোয়াইয়ইয়ের জন্ম বান্দরবানের গজালিয়া ইউনিয়নের গাইন্দ্যাপাড়ায়। পরিবারে ছিল আর্থিক সংকট। এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে, শিক্ষা অর্জনের যাত্রা কখনো সহজ ছিল না। ২০০৯ সালে এসএসসি ও ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন উথোয়াইয়ইয়ে। শিক্ষকতার স্বপ্ন তাকে ২০১২ সালে এনে দাঁড় করায় থানচির হালিরামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে বদলি হয়ে আবার লামার চেয়ারম্যানপাড়ায় ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি।
ছবির ফ্রেমে পাহাড়ের বাস্তবতা
ছাত্রজীবন থেকেই উথোয়াইয়ইয়ের ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফির প্রতি ছিল আগ্রহ। ছুটি পেলেই ছুটে যেতেন দুর্গম পাহাড়ে, ছবি তুলে, ভিডিও করে, তা তুলে ধরতেন ফেসবুকে। ২০১৫ সালে তিনি ‘উথোয়াই ভয়েজার’ নামে একটি পেজ খোলেন। সেখান থেকেই শুরু হয় তার পাহাড়ের গল্প শোনানোর যাত্রা।
কলি থেকে ফুল: প্রথম স্কুলের গল্প
২০১৬ সালে শাহারিয়ার পারভেজসহ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে গজালিয়ার এক ম্রো পাড়ায় তৈরি হয় একটি মাচাংঘরের স্কুল। উথোয়াইয়ই এই উদ্যোগে যুক্ত হয়ে স্কুলটিকে রূপ দেন একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয়। নাম দেন—‘পাওমুম থারক্লা’, যার অর্থ কলি থেকে ফোটা ফুল।
চার পাহাড়, চার আলোর কণিকা
পাওমুম থারক্লার পর একে একে প্রতিষ্ঠিত হয়—চেননৈ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (২০২১, সরই ইউনিয়ন), রেংয়নপাড়া আশা-হোফনূং বিদ্যালয় (২০২২, নাইক্ষ্যংছড়ি), পোপা বদলা আশা-হোফনং আনন্দময়ী বিদ্যালয় (২০২৪)। প্রত্যেকটিই একেকটি দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষা বাতিঘর।
স্কুল যেভাবে চলে
স্কুলগুলো চলে স্থানীয়দের সহযোগিতা, স্বেচ্ছাশ্রম আর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের মডেলে। প্রতিটি শিশুর জন্য প্রতিমাসে ২০০ টাকা দিয়ে থাকেন অভিভাবকরা। স্কুলের নামে পাড়ার হেডম্যানরা জমি দেন, সেখানে গড়ে ওঠে বাগান। সেই বাগানের ফল বা বাঁশ বিক্রি করে চলে বিদ্যালয়ের খরচ।
পাহাড়ের প্রতিটি শিশুই যেন ফোটে ফুল হয়ে
বর্তমানে গজালিয়ার কালোপাড়ায় নতুন বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে, নাম হবে ‘সাইরাও থারবা’। উথোয়াইয়ই বলেন, ‘আমি ছুটে চলি শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে। পাহাড়ের শিশুদের চোখেমুখে আমি দেখতে পাই এক নতুন সম্ভাবনার বাংলাদেশ।’ এই তরুণের পদচিহ্নে জেগে উঠছে নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন। পাহাড়ের নির্জনতায় ফুটে উঠছে শিক্ষার দীপ্ত আলো—যার আভা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা জনপদে।