বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

উন্নয়নশীল বিশ্বে রাষ্ট্রনায়ক কেন প্রয়োজন

আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩০

বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায়শই 'নেতা (লিডার)' এবং 'রাষ্ট্রনায়ক (স্টেটসম্যান)' শব্দ দুইটি ব্যবহৃত হয়। আপাতদৃষ্টিতে ইহা সমার্থক মনে হইলেও, এই দুইটি ধারণার মধ্যে বিদ্যমান। আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একজন নেতা হয়তো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বা দলের স্বার্থ রক্ষা করেন এবং সাময়িক জনপ্রিয়তা অর্জন করিতে পারেন; কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক দূরদর্শী এমন এক জননেতা, যিনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাশ ও দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেন। তিনি সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠিয়া দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন।

অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রনায়ক হইলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, দক্ষ ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তিত্ব। একজন রাজনীতিবিদ নির্বাচিত হইবার জন্য বা ক্ষমতা লাভের স্বার্থে যে কোনো কথা বলিতে বা যে কোনো কাজ করিতে পারেন। পক্ষান্তরে একজন রাষ্ট্রনায়ক তিনিই, যিনি তাহার প্রতিনিধিত্ব করা জনগণের সাধারণ কল্যাণের জন্য সকল কিছু করেন (জনি কিলহেফনার, স্টেটসম্যান ভার্সেস পলিটিশিয়ান, ২০১৬)। তিনি আসলে একসময় জনগণের ঐক্য ও সংহতির প্রতীকে পরিণত হন। একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ককে কতিপয় মূল্যবোধ, আদর্শ ও প্রজ্ঞার অধিকারী হইতে হয়। তাহার মধ্যে সততা, ন্যায়বিচার বোধ, আত্মসংযম, উদারতা ও মহত্ত্বের মতো গুণাবলির সমন্বয় ঘটে। কেবল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য তিনি তাহার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ পরিবর্তন করেন না। যদি জনগণের মঙ্গলের জন্য নীতির পরিবর্তন অপরিহার্য হয়, তাহা হইলে সেই পরিবর্তন তিনি অবশ্যই করেন, তাহা যতই সমালোচিত হউক না কেন। আবার একজন রাষ্ট্রনায়ক একজন সম্রাট বা রাজার মতো নহেন। কারণ তাহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এক নহে। একজন রাষ্ট্রনায়ক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চান না, বরং তিনি তাহাদের শিক্ষিত করিতে চান, যাহাতে তাহারা একটি গণতান্ত্রিক দেশে বসবাসের যোগ্য হইয়া উঠেন। দার্শনিক প্লেটোর মতে, একজন রাষ্ট্রনায়ক কেবল তাহার জনগণকে শিক্ষিতই করেন না, তিনি কোনো না কোনোভাবে তাহাদের চরিত্রও গঠন করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ছিলেন একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক। কেননা তিনি সেই দেশের গৃহযুদ্ধের সময় অত্যন্ত ঝুঁকির মুহূর্তে দক্ষতার সহিত বৈদেশিক নীতি পরিচালনা করেন, যখন যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি হস্তক্ষেপের জন্য ছিল দুর্বল অবস্থায়। সেইখান হইতে দেশকে রক্ষা করিয়া অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পরবর্তীকালে বিশ্বশক্তিতে পরিণত হইবার ভিত্তি স্থাপন করেন। তাই বর্তমান বিশ্বের জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে রাষ্ট্রনায়কের প্রয়োজনীয়তা সবচাইতে অধিক অনুভূত হইতেছে।

একজন স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক বর্তমানের প্রেক্ষাপট বিচার করিয়া ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম একটি সুস্পষ্ট ভিশন তুলিয়া ধরেন জাতির সম্মুখে এবং সেই লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। একজন নেতা হয়তো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যাহা তাৎক্ষণিক সুবিধা বহিয়া আনিতে পারে; কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক সেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যাহা দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও প্রগতির পথে দেশকে আগাইয়া লইয়া যায়। আমরা জানি, উন্নয়নশীল দেশসমূহ আজ দারিদ্রদ্র্য, দুর্নীতি, অশিক্ষা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এই পরিস্থিতিতে একজন প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কই জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করিতে পারেন। তিনি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করিবেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিবেন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করিবেন। তাহার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হইবে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ অন্যান্য জাতির সহিত বন্ধুত্ব ও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হইবে।

উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রায়শই ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের প্রাধান্য দেখা যায়। এই প্রেক্ষাপটে একজন নীতিবান রাষ্ট্রনায়ক হইতে পারেন আলোকবর্তিকাস্বরূ প। অতএব, এই সকল দেশ ও জাতির অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য কেবল নেতার প্রয়োজন নহে, বরং অধিক প্রয়োজন দূরদর্শী ও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনায়কের-যিনি সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠিয়া বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে কাজ করিবেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাখিয়া যাইবেন একটি উন্নত ও স্থিতিশীল দেশ।

ইত্তেফাক/এমএএম