বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

'নয়ন মেলি শুধু দেখে যাও' 

আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:০০

মূলত দুইটি জিনিস না থাকিলে জীব প্রজাতির অস্তিত্ব বিলীন হইয়া যাইবে। ইহার একটি হইল খাদ্য, অন্যটি রিপ্রডাকশন, অর্থাৎ প্রজনন। মানুষ তো সৃষ্টির সেরা জীব। সুতরাং এই দুইটির পাশাপাশি মানুষ আরো একটি চাহে-তাহা হইল শান্তিতে বসবাস। প্রখ্যাত কবি শহীদ কাদরী লিখিয়াছেন-'প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...'।

যিনি ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকেন, তিনিও শান্তি চাহেন, যিনি আলিশান অট্টালিকাবাসী তিনিও শান্তির অন্বেষণ করেন। অর্থাৎ শান্তি ধনী-নির্ধন-সকলেই চাহেন। আরো একটি মিল গরিব-ধনী সকলেরই রহিয়াছে-তাহা হইল-মানুষ মহান আল্লাহর নিকট হইতে আসিয়াছে, চলিয়াও যাইবে আল্লাহর নিকট। অর্থাৎ আমরা এই জগতে মোসাফির মাত্র। ক্ষণিক সময়ের জন্য আসা, অন্যদিকে চিরকালের জন্য চলিয়া যাওয়া। অথচ এই ক্ষণিক সময়ের ব্যাপ্তিকাল-ধরা যাক শত বৎসর-আমাদের নিকট ভ্রমক্রমে দীর্ঘ সময় মনে হয়। আর এই বিভ্রান্তিময় দীর্ঘ সময়ের তিষ্ঠকালে আমরা শান্তি চাই। 

শান্তি চাই বটে; কিন্তু আমরা শান্তির ছায়ার পিছনে ছুটিয়া মরিতেছি। অথচ শান্তি ও স্বস্তিতে থাকিবার স্বার্থেই মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটিয়াছে। সিন্ধু সভ্যতা হইতে শুরু করিয়া মিশরীয়, সুমেরীয়, পারস্য, ব্যাবিলনীয়, রোমান প্রভৃতি সভ্যতার মূলে ছিল মানবজীবনে স্বস্তিদান করা। বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা আরাম আয়েশের একটি প্রাচুর্যময় পৃথিবীতে বসবাস করিতেছি। উনবিংশ শতাব্দীতেও একজন রাজাবাদশা চাহিলেও আজিকার মতো ভোগবিলাস করিতে পারিত না। এখন একজন সাধারণ মধ্যবিত্তের বাড়িতেও এমন ব্যবস্থা থাকে যে, গরম লাগিলে এক সুইচেই ঠান্ডা হাওয়া, ঠান্ডা লাগিলে গরমের ব্যবস্থা। যদিও অন্য সকল বিজ্ঞানের তুলনায় চিকিৎসাবিজ্ঞান পিছাইয়া রহিয়াছে, তাহার পরও মারণ জীবাণুর সংক্রমণ ঘটিলেই এখন আর মৃত্যু-আতঙ্কে নিশি যাপন করিতে হয় না। অসংক্রামক রোগেরও রহিয়াছে উপযুক্ত সকল চিকিৎসা। অন্যদিকে ভোগবিলাস খাদ্যখানায় বিচিত্র রেসিপি, যখন-তখন দেশে-বিদেশে উড়াল দিয়া বেড়াইতে যাওয়া-সকল কিছুই যেন আলাদিনের চেরাগের মতো, চাহিলেই পাওয়া যায়। এত কিছু পাওয়া যায় বটে; কিন্তু শান্তি কোথায়? কোথায় পালাইল শান্তি? শান্তি কি আসে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন-'নয়ন মেলি শুধু দেখে যাও, হৃদয় দিয়ে শুধু শান্তি পাও।'

আসলে শান্তি হইল দুইটি বিষয়ের সমন্বয়। উহার একটি হইল-নিরাপত্তা, অন্যটি আমাদের মানসিক দিক। ইংরেজিতে ইহাকে বলা হয়-পিস অব মাইন্ড ইজ এ মেন্টাল স্টেট অব কামনেস অর ট্রাংকুয়িলিটি। ইহা হইল উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা হইতে মুক্তি পাওয়া; কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা হইতে মুক্তি পাইতে হইলে নির্জন বনে যাইয়া বসবাস করিতে হইবে। আরণ্যিক যুগের সেই অরণ্যও নাই, সেই নির্জনতাও নাই। আমাদের চারিদিকে ছায়াযুদ্ধ, শীতলযুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জটিল পরিস্থিতি। ভূরাজনৈতিক কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচিত্র ধরনের অস্থিরতা ও যুদ্ধাবস্থা দেখা যাইতেছে। কান্ডারি হুঁশিয়ার কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলিয়াছেন-'অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ'। তাহা হইলে উপায়? ইংরেজিতে একটি কথা আছে-ওয়ার ফর পিস। অর্থাৎ শান্তির জন্য যুদ্ধ; কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর শান্তির অহিংস বাণী এইভাবেও শুনাইয়াছেন যে-'চোখের বদলা লইতে অন্যের চোখ উপড়াইয়া লইলে একসময় সমগ্র পৃথিবী অন্ধ হইয়া যাইবে।' সেই ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ করিতে হয় রোনাল্ড রিগানের কথা-'শান্তি মানে সংঘাতের অনুপস্থিতি নহে, ইহা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত পরিচালনা করিবার ক্ষমতা।' জটিল কথা। যেমনটি বলিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যায়কে সহ্য না করিবার কথা। তিনি আরেকটি কবিতায় বলিয়াছেন- 'নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-।'

সত্যিই কি শান্তির ললিত বাণী ব্যর্থ পরিহাসের মতো শুনাইবে? তাহা হইলে মানবসভ্যতা বিকাশের মূলে যেই স্বস্তিদান ছিল, তাহা কি ভুলপথে পরিচালিত হইতেছে? মানবজাতিকে কি পুনরায় সভ্যতার শুরুতে ফিরিয়া নূতন সঠিকপথে যাত্রা শুরু করিতে হইবে? আর কি কোনো উপায় নাই স্বস্তিময় জীবন পাইবার?

ইত্তেফাক/এএম