রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বিচারালয়ে লাঞ্ছনা ও আইনের শাসন

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০০

আইনের আশ্রয় পাওয়ার পবিত্র জায়গা হইল আদালত প্রাঙ্গণ। যেইখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেইখানে যখন পুলিশি হেফাজতে থাকা বিচারাধীন আসামিরা অপমান-লাঞ্ছনা বা হামলার শিকার হন, তখন তাহা শুধু চিন্তার বিষয় নহে, বরং আইনের শাসনের উপর ইহা এক ধরনের চপেটাঘাত। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই এমন দৃশ্য দেখা যায়, যেইখানে ভিআইপি বা রাজনৈতিক নেতাদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় সাধারণ মানুষ এমনকি আইনজীবীরা পর্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেন, কটু কথা বলেন বা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এমনকি শারীরিকভাবে আক্রমণ করিতে উদ্যত হন বা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করিয়া বসেন। যেই সরকারের আমলেই এইরূপ ঘটনা ঘটুক না কেন, ইহা আইনের শাসনের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করিয়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অথচ পুলিশি হেফাজতে থাকিবার সময় কোনো আসামির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান দায়িত্ব। আদালতে আনা-নেওয়ার সময় যদি সেই নিরাপত্তা নষ্ট হয় এবং আসামিকে বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলার শিকার হইতে হয়, তাহা হইলে তাহা পরিষ্কারভাবে আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না পর্যন্ত আদালতের বিচারে দোষী প্রমাণিত হন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আইনের চোখে নির্দোষ। তাহার সহিত সম্মানজনক ব্যবহার করা এবং আইনি প্রক্রিয়া ভালোভাবে সম্পন্ন করিবার পরিবেশ তৈরি করা খুবই জরুরি। দ্বিতীয়ত, যখন কোনো আসামি ভয় বা আতঙ্কের মধ্যে থাকেন, তখন তাহার পক্ষে স্বাভাবিকভাবে আইনি লড়াই চালাইয়া যাওয়া কঠিন হইয়া পড়ে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাহার আইনজীবীরাও নিরাপদ বোধ করেন না, যাহা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে সৃষ্টি করে অন্তরায়। বলা বাহুল্য, আইন নিজের হস্তে তুলিয়া লওয়া বা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করিবার চেষ্টা করা কোনোভাবেই যুক্তি ও ন্যায়সংগত হইতে পারে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ধৈর্য ধারণ করা এবং আইনি প্রক্রিয়ার উপর ভরসা রাখা একান্ত আবশ্যক। যদি এইরূপ ঘটনায় আসামির হতাহতের ঘটনা ঘটে, তাহা হইলে তাহাতে বিশ্বে সেই দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এমনকি সেই দেশ বহির্বিশ্ব হইতে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিরও হইয়া যাইতে পারে যাহা গ্লোবাল ভিলেজ ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এই যুগে মোটেও কাম্য নহে। এই অবস্থা চলিতে থাকিলে মানুষের মধ্যে আইনি ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস যেমন কমিয়া যাইবে, তেমনি সমাজে দেখা দিতে পারে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা।

এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করিতে হইলে অভিযুক্তদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে এবং কোনো ধরনের গোলমাল বা বিশৃঙ্খলা কঠোরভাবে দমন করিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, এইরূপ ঘটনার পিছনে যাহারাই থাকুক না কেন তাহাদের বিরুদ্ধে লওয়া উচিত আইনানুগ ব্যবস্থা। এই যে উন্নয়নশীল দেশে সাবেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে এইরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হইতেছে, আসলে তাহার শেষ কোথায়? তাহাদের মধ্যে এমন অনেকেই থাকেন বা আছেন যাহারা বয়োবৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অসুস্থও বটে। এই সকল দেশে একদিকে চলে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি, অন্যদিকে কোর্ট-কাচারিতেও যদি এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হইতে থাকে তাহা হইলে জনমনে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নহে। তাহা ছাড়া যেই সকল দেশে গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুথানের মাধ্যমে পরিবর্তন আসে, সেই দেশের নাগরিকদের উচিত এই পরিবর্তনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা; কিন্তু যখন উপরিউক্ত অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিতেই থাকিবে, তখন দেশে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার অবসানের আশা করা বৃথা। অথচ সাধারণ মানুষ চায়-শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা। অস্থিতিশীলতা লাগিয়া থাকিলে আবার পরবর্তী পরিবর্তনের প্রশ্নটি সম্মুখে চলিয়া আসিতে পারে। কেননা আমাদের মনে রাখিতে হইবে পরিবর্তনের আসলে কোনো শেষ নাই।

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, 'টুডে ইজ নট আ লাস্ট নাইট'। ইহাকেই আমরা বাংলায় এইভাবে বলিয়া থাকি-'এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে'। অতএব সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকিতে হইবে।

ইত্তেফাক/এমএএম