আজকের এই পৃথিবী, যাহা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও প্রযুক্তির আশ্চর্য অগ্রগতিতে গর্ব করে, সেই পৃথিবীতেই মানবতা বারবার অপমানিত হইতেছে। গাজা উপত্যকার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মানবসভ্যতার জন্য এক গভীর লজ্জা ও আত্মসমালোচনার কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে বটে। ইসরাইল কর্তৃক অব্যাহত অবরোধ, ড্রোন হামলা এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছাইতে যাওয়া জাহাজে আক্রমণ-এই সকল ঘটনা কেবল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন নহে, বরং মানবতার বিরুদ্ধে এক নির্মম আঘাত।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ত্রাণবাহী জাহাজ আন্তর্জাতিক জলসীমায় যাহা ইসরাইলের ড্রোন হানায় ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে, তাহার ঘটনাই প্রমাণ করে-বিশ্ব এখন এমন এক স্থানে দাঁড়াইয়াছে, যেইখানে বোমা ও গোলার মুখে দুধ ও ঔষধ পরাজিত হইতেছে। বেসামরিক জাহাজে সশস্ত্র হামলা শুধু আন্তর্জাতিক জলসীমার নীতিমালা লঙ্ঘনই নহে, ইহা এক প্রকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যেইখান হইতে কেবল বিবৃতি প্রদান করিয়া থাকেন, সেইখানে ইসরাইল দুঃসাহসে এই সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করিতে পারে বলিয়া প্রতীয়মান হয়। অথচ সেই জাহাজটিতে ছিল খাদ্য, ঔষধ, শিশুখাদ্য-প্রাণ রক্ষার সামগ্রী। মাল্টার উপকূলে ড্রোনের আঘাতে যখন জাহাজে আগুন লাগিল এবং ইঞ্জিন বিকল হইল, তখন ৩০ জন নিরস্ত্র তুর্কি ও আজারবাইজানি নাগরিক প্রাণপণ চেষ্টা করিলেন তাহা ভাসাইয়া রাখিবার। ইহাই মানবতার প্রকৃত মুখ-যেইখানে জীবন রক্ষার জন্য মানুষ সর্বস্ব দিয়া লড়িয়া যায়, সেইখানে রাষ্ট্রের মসৃণ ভাষা ও কূটনীতির মুখোশধারীরা নিষ্ক্রিয়।
গাজা আজ এক কারাগার। তিন মাসেরও অধিককাল ধরিয়া সেইখানে মানবিক সহায়তা প্রবেশ করিতে পারিতেছে না। জাতিসংঘ ও ইউনিসেফ যাহা বলিয়াছে তাহা আমাদের মস্তিষ্ককে অবশ করিয়া দেয়-গাজায় অসংখ্য শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে কেবল খাদ্যের অভাবে। শিশুরা শুধু বোমায় নহে, খাদ্যের অভাবেও মরিতেছে'-এই লাইনটির মধ্যে রহিয়াছে মানবতার চরম পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি। কেহ কেহ বলিতেছেন- 'ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র রূপে ব্যবহার করিতেছে'। কী সাংঘাতিক কথা: অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র রূপে কী করিয়া ব্যবহার করা যাইতে পারে- আজিকার এই সভ্য জগতে? ইহা চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ইহাকে প্রতিহত না করে, তাহা হইলে এই নীরবতার মাধ্যমেই নিজেরাই অপরাধী হইয়া পড়িবে।
বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তা পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য অনুসারে, গাজার প্রায় সকল বাসিন্দা চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিতেছেন। চিকিৎসক আহমেদ আবু নাসির বলিয়াছেন, 'শিশুরা বাড়িয়া উঠিবার জন্য যাহা প্রয়োজন, তাহা গাজার উত্তরভাগে কিছুই নাই।' ইহা কেবল এক অঞ্চলের নহে, সমগ্র বিশ্বের আত্মজিজ্ঞাসা। আমরা কি এমন এক পৃথিবী নির্মাণ করিতেছি, যাহা শিশুদের জন্য উপযুক্ত নহে?
এই পরিস্থিতিতে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন-মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বাণী, 'অন্যায়ের প্রতি নীরবতা কেবল অন্যায়কে উৎসাহিত করে।' নেলসন ম্যান্ডেলাও বলিয়াছেন, 'সমাজের আত্মার সর্বাপেক্ষা গভীর ও স্পষ্ট প্রকাশ তাহার শিশুদের প্রতি তাহার আচরণের মধ্য দিয়াই প্রকাশ পায়।' সুতরাং পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র, বিশেষত উন্নত ও শক্তিধর দেশগুলির নিকট আহ্বান-মানবিকতার প্রশ্নে নির্লিপ্ত থাকা চলিবে না। অবিলম্বে গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের পথ খুলিতে হইবে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় ত্রাণবাহী জাহাজে হামলার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করিতে হইবে। মানবিক আইন ও নৈতিকতার পক্ষে দাঁড়াইবার সময় এখনই। এই বিশ্ব যেন শিশুদের জন্য নিরাপদ হয়, যেন প্রতিটি মানবশিশু খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয় পাইয়া বাঁচিবার সুযোগ লাভকরে, তাহার জন্য সকল মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এমন বিশ্ব গড়িতে হইবে, যেইখানে শিশুদের মুখে আবার হাসি ফিরিবে। একটি মানবিক পৃথিবী, যুদ্ধের নহে, শান্তির, সহানুভূতির ও ভালোবাসার। তাহা করিতে না পারিলে 'সভ্যতা' বলিয়া যাহা লইয়া আমরা গর্ব করি, তাহা কেবল অন্তঃসারশূন্য এক মুখোশে পরিণত হইবে।