জীবনের পথে চলিতে গিয়া আমরা কখনও হোঁচট খাই, পথ হারাইয়া ফালাই কিংবা কোনো বৃহৎ অঘটনের সম্মুখীন হইয়া স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত হইবার উপক্রম হই। এইরূপ সংকটকালে আত্মজিজ্ঞাসার তাড়নায় আমাদেরকে ফিরিয়া তাকাইতে হয় অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিকে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই আত্মানুসন্ধান প্রত্যেক জাতির নিকট বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। মার্কাস গার্ভি যথার্থই বলিয়াছেন, 'নিজের ইতিহাস, উৎস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যাহার জ্ঞান নাই, সে ব্যক্তি শিকড়বিহীন বৃক্ষের ন্যায়।' ইংরেজ কবি টি এস এলিয়টও ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বৃক্ষের শিকড়ের সহিত তুলনা করিয়া বলিয়াছেন, 'যেমত বৃক্ষের সমস্ত শক্তি শিকড়ে সংরক্ষিত থাকে, তেমনি একটি সমাজের নান্দনিক সৌন্দর্য ও প্রাণশক্তি ঐতিহ্যের মধ্যেই নিহিত থাকে।'
ইহার বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, শিকড়চ্যুত বৃক্ষ যেমন টিকিয়া থাকিতে পারে না, তেমনি একটি সমাজ যদি নিজ ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়, তাহা হইলে তাহার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা মাটির উপরের পত্রপল্লব দেখিয়া বৃক্ষের সৌন্দর্য বিবেচনা করি; কিন্তু মাটির নিচে শিকড়ের কার্যকারিতা সম্বন্ধে কদাচ ভাবি না। শিকড় হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে বৃক্ষ ধীরে ধীরে প্রাণরস হারা হইয়া মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। অনুরূপভাবে, একটি জাতি যতদিন নিজ ঐতিহ্যকে হস্তগত রাখে, ততদিনই তাহারা নিজেদের 'সভ্য' বলিয়া দাবি করিতে পারে। এই কারণেই পর্যটন কেবল বিনোদনের উপায় নহে, বরং জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি চেতনা জাগ্রত করিবার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আধুনিকতার জোয়ারে ক্রমশ বিলুপ্ত হইবার পথে। বৌদ্ধবিহার, মন্দির, মসজিদ, রাজপ্রাসাদ, প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুকুর, দীঘি, প্রস্তরলিপি, তাম্রলিপি, মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলকচিত্র প্রভৃতি আমাদের অমূল্য প্রত্নসম্পদ। পাশাপাশি রহিয়াছে সুবিশাল পর্যটনকেন্দ্র-বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, পানাম নগরী এবং রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ মোঘল আমলের নানা পুরাকীর্তি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়াইয়া-ছিটাইয়া রহিয়াছে অগণিত ইতিহাসনির্ভর স্থাপনা; কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ইহাদের অধিকাংশই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হইয়াছে। যাহাদের সংরক্ষণের প্রয়াস গৃহীত হইয়াছে, তাহার মধ্যেও রহিয়াছে নানা অভিযোগ ও অনিয়ম।
তবে আশাব্যঞ্জক দিকও বিদ্যমান। গতকাল 'দৈনিক ইত্তেফাক'-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গিয়াছে যে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে ভ্রমণানুরাগী মানুষজন পরিবার-পরিজনসহ নির্জন ও প্রাকৃতিক পরিবেশে অবকাশ যাপন করিবার জন্য ভালুকাস্থ হবিরবাড়ি গ্রিন অরণ্য পার্কে সমবেত হইতেছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত ব্যক্তিবর্গ উক্ত পার্কে প্রতিনিয়ত উপস্থিত হইতেছেন। পার্কটির নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ দর্শনার্থীদের হৃদয় জয় করিয়াছে। এইরূপ কার্যকর উদাহরণ প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে গড়িয়া তুলিতে পারিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট সভ্যতার পাথেয় পৌঁছাইয়া দেওয়া সম্ভব হইবে।
তাহা হইলে করণীয় কী? সর্বাগ্রে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদগুলির যথাযথ সংরক্ষণ নিশ্চিত করিতে হইবে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে প্রকাশ পায় যে, আমাদের দেশের প্রত্নতত্ত্বভিত্তিক সম্পদের যেই বিস্তৃতি, তাহা কার্যকরভাবে রক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় আনিতে আরও দুই শতাব্দীর শ্রম প্রয়োজন হইবে। শুধু উত্তরবঙ্গেই যেই সকল প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রহিয়াছে, তাহার মধ্যে আমরা গত দুই শতাব্দীতে কেবল ১০ শতাংশ স্থান লইয়াই গবেষণা ও সংরক্ষণ করিয়াছি। অর্থাৎ, এখনো ৯০ শতাংশ সম্পদ অব্যবহৃত ও অবহেলিত অবস্থায় রহিয়াছে, যাহা জাতীয়ভাবে এক গভীর বেদনাদায়ক বাস্তবতা।
স্মরণীয় যে, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আগ্রহ বর্তমান বিশ্বে এক বৈশ্বিক প্রবণতা হইয়া উঠিয়াছে। জ্ঞানার্জনের এই প্রবাহ ক্রমেই সর্বসীমা অতিক্রম করিয়া চলিয়াছে। এমতাবস্থায়, যদি আমরা জাতি হিসেবে উন্নতি করিতে ইচ্ছুক হই এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট একটি গৌরবময় সংস্কৃতির ধারা প্রোথিত করিয়া যাইতে চাই, তাহা হইলে আমাদের শিকড়ে পানি ঢালিতে হইবে-অর্থাৎ ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতিই হইতে হইবে যত্নশীল ও দায়িত্ববান। আর তাহার জন্য একান্ত প্রয়োজন সদিচ্ছা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা।