জগৎ রহস্যময়, জটিল এবং অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। বাহ্যিকভাবে যাহারা অদম্য, অপরাজেয় ও অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী বলিয়া প্রতীয়মান হন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাহাদেরও অন্তরে কোথাও না কোথাও এক অদৃশ্য দুর্বলতা রহিয়াছে। এই দুর্বলতাই কখনো তাহাদের পতনের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। Achilles heel নামক প্রবাদবাক্যটি এই চিরন্তন সত্যকেই প্রতীকীরূপে প্রকাশ করে। গ্রিক পুরাণ অনুসারে, বীর অ্যাচিলিস ছিলেন ট্রয় যুদ্ধের এক অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা। তাহার মা থেটিস তাহাকে অমর করিবার আশায় স্টাইক্স নদীতে চুবাইয়াছিলেন; কিন্তু চুবাইবার সময় যেই হেতু তিনি তাহাকে গোড়ালি ধরিয়া রাখিয়াছিলেন, অতএব সেই স্থানটি অমর হইল না। ইহার পরে ট্রয় যুদ্ধের এক ক্রান্তিলগ্নে অ্যাচিলিসের গোড়ালিতে বিদ্ধ হইল পারিসের ছোড়া একটি তির-আর সেইখান হইতেই তাহার মৃত্যু হইল। এই কাহিনি বুঝাইয়া দেয়, একজন মানুষ যতই শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হউক না কেন, তাহার একটি দুর্বল স্থান থাকিবেই। আর সেই স্থান হইতেই চরম বিপর্যয়ের সূচনা ঘটে।
বলা যায়, এই জগতের প্রত্যেকের একটি 'অ্যাচিলিসের গোড়ালি' রহিয়াছে। সেই দুর্বল জায়গাটিই কোনো এক ক্ষণে তাহার সর্বনাশ ডাকিয়া আনে। এই ধারণা কেবল 'বীর অ্যাচিলিস'-এর মতো একটিমাত্র কাহিনির মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে। পুরাণ, ইতিহাস ও জীবনচর্চায় এমন বহু ঘটনার সাক্ষাৎ মিলে। রামায়ণের বীর রাবণ, দশমস্তক ও অমোঘ শক্তির অধিকারী হইলেও তাহার পতন হইয়াছিল নিজ অহংকার ও সীমাহীন কামনার কারণে। মহাভারতে কর্ণ ছিলেন এক অতুলনীয় বীর; কিন্তু যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের কৌশলগত পরিকল্পনায় কর্ণের বিবিধ দ্বিধা ও দুর্বলতাই তাহাকে পরাজয়ের মুখে ঠেলিয়া দেয়।
আধুনিক কালে 'বাটারফ্লাই অ্যাফেক্ট' বলিয়া একটি তত্ত্ব রহিয়াছে, যাহা বলে-একটি ছোট্ট ঘটনা বিশাল এক প্রভাবের জন্ম দিতে পারে। একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানিতেও পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হইতে পারে। বাস্তবে আমরা এমন বহু ঘটনার সাক্ষাৎ পাই, যাহাতে সামান্য একটি উপেক্ষিত ঘটনা, কয়েকটি কথা বা শব্দ-সম্পূর্ণ ঘটনার গতিপথ পালটাইয়া দেয়। বস্তুত, মহাজগতে মানুষের পরিকল্পনা যতই পরিপক্ক হউক না কেন, তাহা যে সর্বজ্ঞ বা চূড়ান্ত নয়, তাহা প্রমাণ করে এই সকল রহস্যময় পরিণতি। মানুষ ভাবে এক; কিন্তু মহান আল্লাহ্ চাহেন আর এক। তিনিই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনিই জানেন কোন মুহূর্তে কাহার কী প্রয়োজন, অথবা কে কোন অবস্থায়, কীভাবে পতনের মুখে পড়িবে অথবা উন্নতির শিখরে উঠিবে। আমরা জানি না কাহার অন্তরে কী চলিতেছে, কিংবা আগামীকাল কাহার জন্য কী রহিয়াছে। এই রহস্যময়তা এবং দুর্বলতা যাহারা জানেন, তাহারা কখনো আত্মঅহংকারে পতিত হইবেন না। ইহার বিপরীতে, যাহারা মনে করে তাহারা দুর্ভেদ্য, অপরাজেয়-তাহাদের মনে রাখা উচিত, কোনো এক নিখুঁত ত্রুটি অপেক্ষা করিতেছে তাহাদের পতনের জন্য। 'অ্যাচিলিসের গোড়ালি' অবশ্যই রহিয়াছে তাহাদের কোথাও। এই সত্যজ্ঞান একজন জ্ঞানীকে নম্রতা শেখায়, আত্ম-অহংকার হইতে দূরে রাখে।
অতএব, অ্যাচিলিসের গোড়ালি হইতে বাটারফ্লাইয়ের পাখার ঝাপটাটি পর্যন্ত সকলই এক রহস্যময় পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আর এই জগতে, যেইখানে সামান্য একটি পদক্ষেপ বদলাইয়া দিতে পারে ভবিতব্য, সেইখানে আত্মম্ভরিতার কোনো স্থান নাই। বরং আছে পরম করুণাময়ের উপর নির্ভর করা, আর নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝিয়া আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হওয়া। এই হেতুই একজন মানুষ যত শক্তিশালী বা ক্ষমতাধর হউক না কেন, তাহার হৃদয়ে যদি এই উপলব্ধি জন্মায়-তাহা হইলেই তিনি নিজেকে রক্ষা করিতে পারিবেন; সাধারণ মানুষও অনিষ্ট-অশান্তি-দুর্ভোগ হইতে রক্ষা পাইবে।