তিলোত্তমা ঢাকা মহানগরী আজ এক নূতন উপদ্রবের সম্মুখীন। মশার যন্ত্রণায় জর্জরিত নগরবাসীর জীবনে সম্প্রতি যুক্ত হইয়াছে মাছির উৎপাত, যাহা জনস্বাস্থ্যকে এক নূতন হুমকির মুখে ঠেলিয়া দিতেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, রাজধানীর ত্রুটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণেই এই মশা ও মাছির উপদ্রব বৃদ্ধি পাইয়াছে, ইহার পাশাপাশি বাড়িয়াছে মাছিবাহিত রোগবালাইয়ের আশঙ্কা। যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ, দূষিত বায়ু আর দুর্গন্ধ নগরবাসীর জীবনকে করিয়া তুলিতেছে দুর্বিষহ। শহরের পরিবেশের উপর ইহা ফেলিতেছে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব। বিশেষত এই সকল আবর্জনার স্তূপ হইতে নির্গত দূষিত পদার্থ বৃষ্টির জলের সহিত মিশিয়া নিকটস্থ জলাশয়গুলিকে দূষিত করিতেছে, যাহা জনস্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্য উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হইতেছে, যাহার ফলে বায়ুমণ্ডলে মিশিতেছে বিষাক্ত ধোঁয়া। এই সকল কার্যকলাপ পরিবেশ দূষণকে আরো তীব্র করিয়া তুলিতেছে এবং নগরবাসীকে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন করিতেছে। এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
রাজধানীবাসী বলিতেছেন যে, গৃহে মাছির যন্ত্রণা অসহনীয়। তাহাদের মতে, বর্তমানে এমন পরিস্থিতি দাঁড়াইয়াছে যে, কোনো খাদ্যদ্রব্য উন্মুক্ত রাখিবার উপায় নাই, মুহূর্তের মধ্যেই মাছি আসিয়া ভনভন করিতেছে। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, গৃহস্থালির পচনশীল ও ভেজা বর্জ্য মাছির বংশবৃদ্ধির প্রধান কারণ। বিগত কয়েক মাসে ঢাকা শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে শৈথিল্য ও বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হইয়াছে, তাহার ফলস্বরূপ রাস্তার ধারে যত্রতত্র বর্জ্যের স্তূপ জমিতেছে। এমনকি, নূতন নূতন স্থানেও বর্জ্য ফেলিবার প্রবণতা দেখা যাইতেছে। এই সকল কারণে মাছির বংশবিস্তারের জন্য এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে। রাস্তাঘাট ও হাটবাজারেও গত এক দশকে এত অধিক মাছি আর কখনো দেখা যায় নাই বলিয়া নাগরিকগণ দাবি তুলিতেছেন। ফলফলাদির মৌসুম জ্যৈষ্ঠ মাস অত্যাসন্ন। তখন পরিস্থিতি কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে তাহা বলা মুশকিল।
প্রাণিবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, অপরিষ্কার, নোংরা ও নর্দমার ন্যায় স্থানেই মাছির জন্ম হয়। বর্তমানে ঢাকা শহরের চারিদিকে যে নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ বিরাজ করিতেছে এবং সড়ক ও বাসাবাড়িতে বর্জ্যের স্তূপ যেইভাবে বাড়িয়াছে, তাহাতে মাছির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া অস্বাভাবিক নহে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করিয়া দেখা যায়, জুরাইন হইতে দয়াগঞ্জ পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কে এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে জমিয়া রহিয়াছে বর্জ্যের স্তূপ। ইহা ছাড়া এজিবি কলোনি, মান্ডা, বাড্ডা, গুলশান, গুদারাঘাটের ন্যায় সেকেন্ডারি বর্জ্যের ভাগাড়গুলিতে মাছির উপদ্রব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইহা জনগণকে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তির মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে। জনস্বাস্থ্যবিদগণের মতে, মশা ও মাছির বৃদ্ধি সরাসরি জনস্বাস্থ্যের উপর কুপ্রভাব ফালায়। মাছি বাড়িলে টাইফয়েড, ডায়রিয়া ও আমাশয়ের ন্যায় রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। বর্জ্য বৃদ্ধি পাইলে বাড়ে ইঁদুরের সংখ্যাও। মাছি বর্জ্য হইতে জীবাণু বহন করিয়া খাদ্যে মিশাইয়া দেয় এবং সেই খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষ নানা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়।
অতএব, বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে। স্থানীয় সরকার এবং সিটি করপোরেশন এই বিষয়ে তাহাদের দায়িত্ব এড়াইতে পারে না। নাগরিকগণের মৌলিক চাহিদাগুলির মধ্যে একটি হইল পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূরীকরণে তাহারা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে কেন এত উদাসীন? নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ, পর্যাপ্ত ডাস্টবিন স্থাপন এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগ আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি। কেবল তাহাই নহে, নগরবাসীকেও এই বিষয়ে সচেতন হইতে হইবে। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা বন্ধ করিতে হইবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মাবলি মানিয়া চলিতে হইবে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে একটি সমন্বিত ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তাহার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। এই পরিকল্পনায় বর্জ্য সংগ্রহ হইতে শুরু করিয়া পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত সকল স্তরের আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে। ইহার পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।